কিছু উপলব্ধি, কিছু আশাবাদ

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনবাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

জানুয়ারি কি ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। আমার কলেজ ঢাকা শহরের ব্যস্ততম ও ধূলিময় এলাকায়। সে কারণে বুঝতে পারি, এখানে নিয়মিত যাতায়াতের জন্য মাস্কের কোনো বিকল্প নেই। একদিন বাধ্য হয়ে ২০ টাকায় একটা ফিল্টারযুক্ত মাস্ক কিনেই ফেললাম। কেনার পরে মনে কেমন একটা খুঁতখুঁতি। মনে হতে লাগল, ঠকে গেলাম নাকি? আরও কম দামেই তো মনে হচ্ছে মাস্ক পাওয়া যায়।

তখনো কি জানি, মাসখানেক পর এই ২০ টাকার মাস্কই সোনায় সোহাগা হয়ে উঠবে? এর দাম হয়ে পড়বে আকাশচুম্বি। কে জানত, আর কিছুদিন পরই মানুষ উৎকণ্ঠায় কাতর হয়ে পড়বে যে সে করোনায় আক্রান্ত হলো কি না। এর আরও কিছুদিন পরে তো সবার আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠল, কোভিডে কতজন মারা গেছে। আর সবচেয়ে বড় স্বস্তি তখনই অনুভব করে, যখন তারা জানতে পারছে, অন্তত গতকালের তুলনায় আজ মৃত্যুর সংখ্যা কিছু কমেছে!

এরপর তো কয়েকটা মাস পার হয়ে গেল। কলেজের কথা বারবার মনে উঁকি দেবে, সেটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে নটর ডেম কলেজে তো আমাদের আনন্দের শেষ নেই। আমি দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র বলে হয়তো এক বছরের জুনিয়র (যারা এখনো কলেজে ভর্তি হয়নি) আর এক বছরের সিনিয়র (যারা এখনো এ বছর এইচএসসি দেয়নি) শিক্ষার্থীদের তুলনায় কিছুটা কম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় আছি।

মাঝেমধ্যে এলাকাটিতে গিয়ে চক্কর দিয়ে দেখে আসতে ইচ্ছা করে। এখনো কি পল্টনের মোড়ের বিখ্যাত যানজট লেগে থাকে প্রতিদিন? বায়তুল মোকাররমের সামনে এখনো কি হকাররা বসেন জীবনযাপনের যাবতীয় উপকরণ নিয়ে? কত দূর এগোল মেট্রোরেলের কাজ? প্রেসক্লাবের সামনে কি টুকটাক আন্দোলন বা অনশন এখনো হয়? বৃষ্টিতে কত ফুট পানি জমেছিল এবার মতিঝিলে? ভোরে ঘুম থেকে উঠে কলেজের উদ্দেশ্যে মতিঝিল যাওয়া এবং দুপুর বা বিকেলে বাসে করে ফিরে আসাকে মনে হয় কোনো সুদূর সময়ের কল্পনা। এগুলো তো সব বাস্তবে সম্ভব। যেটা সম্ভব নয়, তা হলো নিজেকে যাবতীয় পার্থিবতা থেকে মুক্ত করে এনে মানুষের মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখা যে মানুষ কি অবশেষে তার দৌরাত্ম্যের শিক্ষাটা পেল?

সবাই বলছেন, প্রকৃতির ওপর আমাদের হিংস্রতার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। করোনার অতিমারির পেছনে সেটাই নাকি মৌলিক কারণ। প্রকৃতি এখন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সভ্যতার ত্রুটিগুলো।

দার্শনিক কথা থাকুক, এটুকু বলতে পারি যে শিগগিরই হয়তো আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে। এরই মধ্যে করোনায় বন্ধ হয়ে থাকা ক্রিকেট আর ফুটবল আবার মাঠে ফিরেছে। দেশ–বিদেশে অফিস–কারখানা আবার চালু হতে শুরু করেছে। আবার একই সঙ্গে রাস্তায় বাড়তে শুরু করেছে মাস্কবিহীন মানুষের পদচারণ। বন্যা, সড়ক দুর্ঘটনা, দুর্নীতি, প্রতারণার মতো ঘটনাগুলো তো কখনোই থেমে থাকেনি এ দেশে।

তবে ক্লান্ত মন এখন এই সময়ের ইতিবাচক খবরই বেশি খোঁজে। সেসবের দিকেই নজর দেওয়া উচিত বেশি। দুঃসময়েও অনেক হৃদয়বান মানুষের পরোপকারী মনোভাব ও উদারতার পরিচয় পেয়েছি আমরা। বিশ্ব বুঝতে শিখেছে ইন্টারনেটের গুরুত্ব, বের করেছে বিকল্প উপায়ে শিক্ষা ও অফিসের ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য–সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য মনে হয় না এই প্রজন্মের আর কর্মশালা করা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন পড়বে।

পরিবারের মধ্যে থেকেই কাজ করছে মানুষ। পরিবারের সংস্পর্শ পাচ্ছে। করোনাভাইরাসসহ আরও হাজারো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে মানুষের টিকে থাকার উদ্দেশ্য তো একটাই, জীবনের যা কিছু ইতিবাচক, তার দিকে এগিয়ে যাওয়া, তার স্পর্শ পাওয়া, তাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা। অলক্ষ্যেই এসব উপলব্ধি হচ্ছে মানুষের।