কিশোর-কিশোরীর প্রেম-বিয়ে, অতঃপর...

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

একটি কিশোর কণ্ঠ আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে স্থানীয় সাংবাদিকদের ফোন করে জানাল, তার স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন শিকলবন্দী করে রেখেছে। সাংবাদিকেরা কারণ জানতে চাইলে বলল, তারা পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিল। কিশোর কণ্ঠের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সাংবাদিকেরা নিশ্চিত হলেন, সে প্রকৃত অর্থেই কিশোর। সে এবং তার স্ত্রী দুজনেই স্থানীয় স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কিশোরীর ঠিকানা নিয়ে সত্যতা জানতে ওই বাড়িতে ছুটলেন সাংবাদিকেরা।

ঘটনাটি ঘটেছে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা ইউনিয়নে।

ঘটনাটা শুনলে নিশ্চিতভাবে যে কারও মনে তিনটি প্রশ্ন জেগে উঠবে। এক. এই বয়সী ছেলে–মেয়ের বিয়ে আইনসিদ্ধ কি না? দুই. কিশোরীকে বাবা–মা ঘরে শিকলবন্দী করে রাখতে পারেন কি না? তিন. কিশোরকে জেলহাজতে পাঠানো যায় কি না?

তিনটি প্রশ্ন নিয়ে এই প্রতিবেদক যোগাযোগ করলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তমাল হোসেন এবং গুরুদাসপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোজাহারুল ইসলামের কাছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তমাল হোসেন বলেন, পারিবারিক অসচেতনতার কারণে বয়সের ভুলের ফাঁদে পড়েছে দুই শিক্ষার্থী। বাল্যবিবাহ দণ্ডনীয় অপরাধ। তিনি জানান, প্রচলিত আইনে গ্রেপ্তার হয়েছে কিশোর। আদালত ঠিক করবেন কোথায় বিচার হবে। এ নিয়ে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
কিশোরীকে ঘরবন্দী বা শিকলবন্দী করে রাখা প্রসঙ্গে ইউএনওর মন্তব্য হচ্ছে, কাউকেই ঘরবন্দী রেখে মানসিক নির্যাতন করা বিধিসম্মত নয়। এটা অমানবিক কাজ। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

অন্যদিকে কিশোরকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে ওসি মো. মোজাহারুল ইসলাম বলেন, কিশোরীর বাবা কিশোর ও তার বাবাসহ ১৪ জন আত্মীয়কে আসামি করে অপহরণের মামলা করেছেন। ওই আইনে বাবাসহ কিশোরকে গ্রেপ্তার করে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হয়। আদালত তাঁদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরে কিশোর জামিনে বেরিয়ে আসে। ওই মামলাটি নারী ও শিশু দমন ট্রাইব্যুনালে বিচার হবে। তখন আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন, কিশোরকে কোথায় পাঠানো হবে।


ঘটনা যা ঘটেছে
পুলিশ, গ্রামবাসী এবং কিশোরী–কিশোরীর কাছ থেকে যা জানা গেছে, তা হচ্ছে, ছেলে ও মেয়ে দুজনই স্থানীয় এক স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাদের বাড়িও পাশাপাশি। তবে মেয়ের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছেলেটির তুলনায় ভালো। বয়স এবং মেয়ের পরিবার বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় গত ৩ মার্চ কিশোর–কিশোরী পালিয়ে ঢাকায় চলে যায়। ৬ মার্চ বিয়ে করে তারা।

মেয়ের বাবা এ ঘটনা জানার পর মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে অভিযোগ করে থানায় মামলা করেন। ওই কিশোর, তার বাবাসহ ১৪ আত্মীয়কে ওই মামলায় আসামি করা হয়। অপহরণ মামলার প্রায় তিন মাস পর ৩০ মে গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকা থেকে কিশোর–কিশোরীকে উদ্ধার করে পুলিশ।

মেয়েকে পরিবারের হেফাজতে দেওয়া হয়। একই দিন অপহরণ মামলায় কিশোরের বাবাকে গ্রেপ্তার করে বাবা-ছেলেকে নাটোর জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। তবে এ মামলার অন্য আসামিরা গ্রেপ্তার হননি এখনো। এই মামলা নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।


পুলিশের হেফাজত থেকে কিশোরীকে বাড়িতে এনে তার বাবা হাত–পায়ে শিকল বেঁধে ঘরবন্দী করে রাখেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে অপহরণ মামলায় হাজতবাসের পর গত ২৪ জুন জামিনে ছাড়া পেয়েছে কিশোর ও তার বাবা। এরপর আজ কিশোর স্থানীয় সংবাদকর্মীদের মুঠোফোনে শিকলবন্দী দশা থেকে তার স্ত্রীকে উদ্ধারের আকুতি জানায়।

ঘটনার সত্যতা জানতে কয়েকজন সংবাদকর্মী আজ দুপুরে ওই মেয়ের বাড়িতে যান। কিন্তু বাড়ির প্রধান ফটক ভেতর থেকে বন্ধ রাখা হয়। অনেক চেষ্টার পর মেয়ের মা প্রধান ফটক খুলে দেন। মেয়ের অবস্থান জানতে চাইলে নানা অজুহাত দেখান তিনি। প্রায় আধ ঘণ্টা পর পাশের কক্ষ থেকে শিকল খুলে মেয়েকে আনা হয়। মেয়েটির বাঁ পা ও বাঁ হাতে লোহার শিকলের দাগ দেখতে পান সংবাদকর্মীরা।

মেয়েটি অভিযোগ করে, ২৭ দিন ধরে বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে তাকে। বন্দিদশা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আকুতি জানায় সে। মেয়েটি বলে, ‘আমি যেন বাড়ির বাইরে যেতে না পারি, সে জন্য বাম পা ও বাম হাতে লোহার শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। শারীরিক–মানসিক নির্যাতনও করা হয় আমাকে। গোসল, খাবার, শুয়ে থাকার সময়ও শিকলে বাঁধা থাকতে হয় আমাকে।’

কিশোরী আরও বলে, ‘ভালোবেসে ঘর–সংসার করার জন্য স্বেচ্ছায় বাবার ঘর ছেড়ে গেছি। আমাকে অপহরণ করা হয়নি।’ সাংবাদিকেরা তার বয়স কম থাকার বিষয়টি উল্লেখ করলে সে বয়সের বিষয়টি উপেক্ষা করে কিশোরের কাছে চলে যাওয়ার দাবি জানায় এবং কিশোর ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছে উল্লেখ করে তা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানায়।

তবে মেয়েকে শিকলবন্দী করে নির্যাতন করার কথা অস্বীকার করেছেন কিশোরীর বাবা। তিনি বলেন, ‘নির্যাতনও করিনি। শিকল দিয়ে বেঁধেও রাখিনি। শুধু ঘরবন্দী করে রেখেছি।’ ঘরবন্দী রাখার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে তিনি জানান, মেয়ে যেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে দ্বিতীয়বার ভুল না করতে পারে। মেয়ের এবং নিজ পরিবারের সামাজিক সম্মানহানির ভয় থেকে ঘরে আটকে রেখেছেন।

ওসি জানান, কিশোরীকে শিকলে বেঁধে শারীরিক–মানসিক নির্যাতন করার বিষয়টি তাঁর জানা নেই।