কুসংস্কারের বলি এক তরুণ

গত বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ১০টা। মো. সোহান নামের মানসিক ভারসাম্যহীন এক তরুণকে নেওয়া হয় বাড়ির পাশের পুকুরে। পানিতে ডুবিয়ে রাখা গেলে মানসিক সমস্যা দূর হতে পারে, গ্রামের কিছু মানুষের এমন পরামর্শে সোহানকে পানিতে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখা হয়। এতে পানিতেই নিথর হয়ে পড়ে দেহ এবং তীরে টেনে আনার আগেই মারা যান সোহান।

গ্রামবাসীর কুসংস্কারের বলি হয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণের অকালমৃত্যুর এই ঘটনা কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের কালিকাপ্রসাদ উত্তরপাড়া গ্রামের। পুলিশ সোহানের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আতর মিয়া ও মদিনা বেগম দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে সোহান (১৮) সবার ছোট। আতর মিয়া দীর্ঘদিন প্রবাসজীবন শেষে এক বছর আগে দেশে ফেরেন। সাত বছর আগে গ্রামের সড়ক দিয়ে বাইসাইকেল চালানোর সময় দুর্ঘটনার শিকার হন সোহান। এরপর ধীরে ধীরে মানসিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। তবে ছেলের চিকিৎসার বিষয়ে মা-বাবা এতটুকু কার্পণ্য করেননি। ইতিমধ্যে অনেক টাকা খরচ করেছেন। অর্থ ব্যয় আর দুর্ভোগ পোহালেও সোহানের তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছিল না। এতে প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারান পরিবারের সদস্যরা। এ রকম বাস্তবতায় দুই সপ্তাহ আগে গ্রামের কিছু লোক পরামর্শ দেন পুকুরের পানিতে নিয়মিত ডুবিয়ে রাখা গেলে ভালো ফল আসতে পারে। গ্রামবাসীর কথার ওপর আস্থা আসে পরিবারটির। এরপর ১০ দিন আগে থেকে নিয়মিত সোহানকে পুকুরে নেওয়া হয় এবং কিছুক্ষণ পানিতে ডুবিয়ে তারপর বাড়িতে আনা হয়।

গ্রামবাসী এ-ও বলেন, পানিতে ডুবিয়ে রাখার পর সোহান যদি চেতনা হারিয়ে ফেলেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি ধীরে ধীরে রোগমুক্তির দিকে এগোচ্ছেন। ডুবিয়ে রাখার প্রতিবারই সোহান চেতনা হারিয়ে ফেলেন। এতে তাঁর মা-বাবার স্বস্তি বাড়ে। তাঁদের মনে বিশ্বাস জন্মে, সোহান বোধ হয় সুস্থতার দিকে এগোচ্ছেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার চেতনা হারানোর পর আর ফিরে আসেনি।

ছেলের মৃত্যুতে সোহানের মা মদিনা বেগম এখন নিজেই শয্যাশায়ী। কোনোভাবেই এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। শুধু বলেন, ‘আমি এ কী করলাম! কেন মানুষের কথা শুনলাম।’

গ্রামের যাঁরা পানিতে ডুবিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁদের কারোর নাম প্রকাশ করেননি মদিনা বেগম। শুধু বলেন, ‘আমরা তাঁদের কথায় বিশ্বাস রেখেছি।’

সোহানের বাবা আতর মিয়া বলেন, এ পর্যন্ত ছেলের চিকিৎসার জন্য অন্তত ১০ লাখ টাকা খরচ করেছেন।

কালিকাপ্রসাদ ইউপি চেয়ারম্যান মো. ফারুক মিয়া বলেন, ঘটনাটি সত্য। এ ঘটনার পর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নেবেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ বলেন, ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানে মানসিক সমস্যা দূর করতে পানিতে ডুবিয়ে রাখার সুযোগ নেই। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে বিষয়টির খোঁজ নেব এবং এ ধরনের পরামর্শ যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করব।’

ভৈরব থানার ওসি মোখলেছুর রহমান জানান, তাঁরাও পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীনতা দূর করার পরামর্শ দেওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান করছেন।