কৃষকদের আশা দেখাচ্ছে কৃষিবিমা

বন্যায় ফসল হারিয়েছেন হাজির উদ্দিন। এখন চোখ রাঙাচ্ছে নদীভাঙন
ছবি: প্রথম আলো

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের নোয়ানীপাড়া এলাকার মো. হাজির উদ্দিন (৬০)। চার ছেলে ও এক মেয়েসহ স্ত্রী নিয়ে বসবাস করেন। এবারের বন্যার আগে প্রায় ১০ বিঘা জমিতে বাদাম ও আমন ধান লাগিয়েছিলেন। হঠাৎ বন্যা শুরু হওয়ায় নদীভাঙনের কারণে সব ফসল হারিয়ে তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েন। শুকনা মৌসুমে চর জেগে ওঠায় মসুর ও বাদাম লাগিয়েছিলেন। কিন্তু এবার নদীভাঙন শুরু হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। হাজির উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিবছরে নদীভাঙনে আবাদি জমি প্রায় শেষ হওয়ার পথে। চরে জেগে ওঠা কিছু জমিতে বাদাম চাষ করছি। জানি না ঘরে তুলতে পারব কি না।’

এ রকম ফসলডুবি বা নদীভাঙনে ডুবে যাওয়া কৃষকের কথা চিন্তা করে সরকার চালু করেছে কৃষিবিমা। বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও এই ধরনের বিমা চালু করেছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিবিমা জনপ্রিয় হলে কৃষকেরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিমা থেকে ক্ষতির টাকা পাবেন। এই টাকা দিয়ে তাঁরা আবার ফসল লাগাতে পারবেন। এতে তাঁরা ক্ষতির ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সরকার প্রতিবছর যে ত্রাণ দেয়, সেখান থেকে বিমার কিস্তি দিলে অনেক কৃষক এসব কৃষিবিমা থেকে সহায়তা পেয়ে স্বাবলম্বী হবেন।

নদী ভাঙলে ফসল ডুবে যায়। এ নিয়ে চিন্তায় কৃষক
ছবি: প্রথম আলো

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণে কৃষি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবারও কৃষি, উন্নয়নকাজসহ সব পরিকল্পনায় আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি মাথায় রেখে এগোতে হবে। এই ক্ষেত্রে কৃষিবিমার মাধ্যমে কৃষকদের সুরক্ষা দেওয়া যাবে। তবে বিমার কিস্তি বা প্রিমিয়াম যেন বেশি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। কারণ, অনেক দেশে বেশি অঙ্কের প্রিমিয়াম বিদ্যমান, তাই এই ধরনের বিমা সফল হয়নি। আর এ ধরনের বিমার কিস্তি বেশির ভাগই সরকারকে দিতে হবে। যেটি পাশের দেশ ভারতে আছে।

সারা বিশ্বে জলবায়ুজনিত কারণে ফসলের ক্ষতি (লস অ্যান্ড ড্যামেজ) নিয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, এটি নিয়ে কেবল আলোচনা শুরু হয়েছে। উন্নত দেশগুলো এটা মানতে চায় না। আরও দুই বছর লাগবে এ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে। ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কৃষকদের জন্য কৃষিবিমা চালু করার উদ্যোগের কথা জানান। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র বিমা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে যাচ্ছে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাম্প্রতিক একটি সমীকরণ অনুযায়ী প্রাকৃতিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যারা বসবাস করে, তাদের ক্ষতি কীভাবে মেটানো যায় এবং তাদের জীবন কীভাবে নিরাপদ করা যায়, সে জন্য তাদের বিশেষ বিমা ব্যবস্থা করে দিলে তারা নিরাপদ থাকবে।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর গত বছর থেকে কৃষিবিমা চালু করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশন।

সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকের জন্য সরকার আমাদের মাধ্যমে কৃষিবিমা চালু করেছে। আপাতত রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালী ও কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হাওরে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। শাহরিয়ার আহসান বলেন, এটা শুধু সাধারণ বীমা করপোরেশনের কাজ নয়। এখানে কৃষি বিভাগ, আবহাওয়া বিভাগ, অর্থ বিভাগ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় প্রয়োজন। কৃষক বিমার সুবিধা সম্পর্কে জানেন না বা সচেতন নন। এই সচেতনতা আমাদের একার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। সরকারের অন্য বিভাগগুলোর সহায়তাও প্রয়োজন। এটি প্রথমে ভালো করে চালু করতে সরকারে প্রণোদনা লাগবে। সরকার প্রতিবছর যে ত্রাণ দেয়, তা থেকে কিছু কৃষিবিমায় দিলে এর ফল কৃষকেরা পাবেন। কয়েক বছর সরকার সহায়তা দিলেই কৃষক এই বিমার সুবিধা যখন পাবেন, তখন এটি এমনিই জনপ্রিয় হবে। তখন এই ধরনের বিমাতে আগ্রহী হবেন কৃষক। তিনি আরও বলেন, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে কৃষিবিমা চালু আছে। এতে সরকার বা দাতা সংস্থা কৃষকের বিমার কিস্তির টাকা দেয়। বাংলাদেশেও এভাবে চালু করা গেলে এটি জনপ্রিয় হবে।

সরকারের সঙ্গে কৃষিবিমা চালু করতে প্রথম আর্থিক সহায়তা করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার কাজী আজম বলেন, আমরা সাধারণ বীমা করপোরেশনের সঙ্গে কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে আর গ্রিন ডেলটা ইনস্যুরেন্সের সঙ্গে সুনামগঞ্জে গত বছর কৃষকদের বিমার কিস্তি পরিশোধ করি। গত বছর আম্পানে সুনামগঞ্জের হাওরে কৃষকদের ফসল ডুবে যায়। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর হাওর অঞ্চলের ৩১৬ জন বোরো ধানচাষি গত বছরের ২৮ এপ্রিল থেকে ২২ মে গ্রিন ডেলটা ইন্স্যুরেন্সের সূচকভিত্তিক শস্যবিমা সুরক্ষার অধীনে ছিলেন। পরে তাঁরা ক্ষতিপূরণ পান। এবার বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) কুড়িগ্রামের চিলমারীর রানীগঞ্জে আর সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে কৃষকদের বিমার আওতায় এনে আর্থিক সুবিধা দিচ্ছে। গ্রিন ডেলটা ইনস্যুরেন্সের এখন পর্যন্ত দেশের ৪২ জেলার ৬০ হাজার কৃষক আমাদের বিমা সেবার আওতায় এসেছেন। প্রতিষ্ঠানটির হেড অফ ইমপ্যাক্ট বিজনেস ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট শুভাশীষ বড়ুয়া জানান, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি বিমা নিয়েছেন উত্তরাঞ্চলের কৃষকেরা। কেননা, উত্তর অঞ্চলে বেশি বন্যা হয়। বিমা করা থাকলে যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, তাহলে কৃষকেরা ক্ষতিপূরণ পান, যা দিয়ে আবার কৃষিকাজ করতে পারেন। সরকারের তথ্য অনুসারে প্রতিবছর আগাম বন্যায়, অতি বন্যায় প্রচুর ফসলের ক্ষতি হয়। ২০১৭ সালে আগাম ও স্বাভাবিক বন্যায় হাওরের ৫২ লাখ ৫০ হাজার টন ফসলের ক্ষতি হয়। এর আর্থিক মূল্য ছিল ৩ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। আগাম ও স্বাভাবিক বন্যা, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ফসলের ক্ষতির জন্য হাওরের কৃষককে ত্রাণ, নগদ সহায়তা, প্রণোদনাসহ নানা ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

নদীর ওপর নির্ভর করে কুড়িগ্রামের মানুষের জীবন। এই নদী কখনো জীবিকা, কখনো দুঃখের কারণ
ছবি: প্রথম আলো

ভারতে অনেক বছর ধরে চালু আছে কৃষিবিমা। ভারতের গণমাধ্যমে বলা হয়, ভারতের ২৯ কোটি কৃষক এখন শস্যবিমার আওতায়। এই উদ্যোগের পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে গত ১৪ জানুয়ারি দেশটির কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমার এ তথ্য প্রকাশ করেছেন।

কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং বলেন, শস্যবিমা হচ্ছে কৃষকের একমাত্র রক্ষাকবচ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উদ্ভূত শস্যের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে এই বিমা। আর এ জন্যই ২৯ কোটি কৃষক তাঁদের শস্যকে বিমার আওতায় নিয়ে এসেছেন। এ ছাড়া প্রতিবছর সাড়ে ৫ কোটি কৃষক নতুন করে এই বিমার আওতায় আসছেন। গত পাঁচ বছরে সরকার ৯০ হাজার কোটি রুপি বিমা দাবি পরিশোধ করেছে।