কৃষিবিদ তৈরির কারখানা

ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্রের তীরে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ কৃষি িবশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রশাসনিক ভবন। ছবি: প্রথম আলো
ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্রের তীরে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ কৃষি িবশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রশাসনিক ভবন। ছবি: প্রথম আলো

বাংলা অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে কৃষিশিক্ষার সূত্রপাতের ইতিহাস টানতে গেলে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নাম টানতে হবে। তাঁর নিজের রাজনৈতিক দলের নাম ছিল কৃষক-প্রজা পার্টি। ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমবারের মতো একটি কৃষিশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। তিনি ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকায় বেঙ্গল কৃষি ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা কৃষি বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। তবে কৃষিশিক্ষার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন অনুভব করতে থাকেন সেই সময়কার কৃষিবিদেরা। 

১৯৫৮ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। তারা তৎকালীন পাকিস্তান সরকারকে একটি কৃষিবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরামর্শ দেয়। ১৯৫৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে এবং পূর্ব বাংলায় ঢাকার আশপাশের কোনো একটি এলাকায় একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়টি কোথায় স্থাপন করা হবে, তা নিয়ে যখন চলছে আলোচনা, তখন কোনো এক নাম না জানা কৃষিবিদ পরামর্শ দেন, ঢাকার কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে এটি স্থাপন করা যেতে পারে। তখন দেশের হাওর ও সমতল কৃষিভূমির মিলনস্থল হিসেবে ময়মনসিংহের নাম আসে।
ময়মনসিংহ শহর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেঁষে সবুজ বনানীর ভেতর গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। রাজধানী ঢাকা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। ১৯৬১ সালে কৃষি ও ভেটেরিনারি নামের দুটি অনুষদ নিয়ে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম। এর কয়েক মাস পরেই পশুপালন অনুষদের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদ। পরের বছর যুক্ত হয় কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদ। ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষাবর্ষে মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ যুক্ত হয়।
শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে তোলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ওই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এ করিম। তিনি ঢাকা শহরের মায়া ছেড়ে আধুনিক কৃষি গবেষণায় মনোযোগ দিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তাঁর দেখাদেখি অধ্যাপক আবদুল লতীফ, আবদুল ওয়াদুদের মতো খ্যাতিমান কৃষিবিজ্ঞানীরাও যোগ দেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। নতুন কৃষিবিদ তৈরির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়টির মাধ্যমে কৃষি গবেষণার নতুন নতুন দুয়ার খুলতে থাকে। প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশে কাজ করতে আসে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি)। সেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কাজ শুরু করেন। দেশের ধান উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনের কারিগর হিসেবে ইরিতে কাজ করা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের আবহাওয়া ও মাটির উপযোগী ধানের জাত উদ্ভাবন শুরু করেন।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ দেশের সব কটি কৃষিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মী বাহিনী হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। দেশের কৃষি গবেষণায় নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সূত্রপাত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অধ্যাপক এ করিম এখানেই গোবর থেকে বায়োগ্যাস তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রথম দিককার এই প্রযুক্তি সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে।
ষাট ও সত্তর দশকে বিশ্বজুড়ে যে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয়, তার অন্যতম পুরোধা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী নরম্যান ই. বোরলগ। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক বিষয়ক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সবুজ বিপ্লবের বাংলাদেশ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। নরম্যান এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সবুজ বিপ্লবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গবেষণার সূত্রপাত করেন।
১ হাজার ২৫০ একরের এই বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ছয়টি অনুষদের আওতায় ৪৩টি শিক্ষা বিভাগের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৬ হাজার ৯৫৬ জন স্নাতক, ১৭ হাজার ৯৬৯ জন এমএসসি/ এমএস এবং ৬৪১ জন পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। জাপান, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, ইরান, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল থেকে ১১২ জন শিক্ষার্থী এখান থেকে পড়াশোনা করে গেছেন।
২০১৩ সালে বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের জনক বিজ্ঞানী নরম্যান ই বোরলগকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি দেয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি অনুষদে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬ হাজার ৬৪৯। এর মধ্যে ৫ হাজার ১ জন স্নাতক, ১ হাজার ২৪৯ জন এমএস এবং ৩৯৯ জন পিএইচডি পর্যায়ে অধ্যয়নরত। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৬৬ জন শিক্ষক, ৩৫৪ জন কর্মকর্তা ও ১ হাজার ৫৩২ জন কর্মচারী কর্মরত আছেন। শিক্ষকদের মধ্যে ৩১৭ জন অধ্যাপক, ৬৭ জন সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৩৮ ও ৪৪ জন যথাক্রমে সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে বর্ণাঢ্য গবেষণা সাফল্য। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা কার্যক্রম দুটি প্রধান ধারায় পরিচালিত হয়ে থাকে। এর একটি ডিগ্রিভিত্তিক। অন্যটি প্রকল্পভিত্তিক। গবেষণা প্রকল্পগুলো সুষ্ঠুভাবে সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) তত্ত্বাবধানে ১ হাজার ৯২২টি গবেষণা প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং বর্তমানে এর চলমান প্রকল্পসংখ্যা ৪৩২। বাউরেসের তত্ত্বাবধানে ৬টি অনুষদের মাধ্যমে ১৪০টি প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে হস্তান্তর করা হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে হস্তান্তরিত প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে সম্প্রতি গবেষণালব্ধ ৯টি কৃষিপ্রযুক্তির মেধাস্বত্ব অর্জনের জন্য জমা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ফসল ও প্রাণীর রোগ দমনপদ্ধতি, ভ্যাকসিন, শস্য ও মাছের জাত উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যেসব উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শস্যের জাত ও উৎপাদনপ্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে সেসবের মধ্যে বাউকুল, বাউধান-২; সম্পদ ও সম্বল, বাউ-এম/৩৯৫, বাউ-এম/৩৯৬ নামের ৪টি উফশী সরষের জাত, ডেভিস, ব্যার্গ, সোহাগ, জি-২ ও বিএস-৪ নামে ৫টি সয়াবিন জাত, কমলাসুন্দরী ও তৃপ্তি নামে আলুর জাত, লতিরাজ, বিলাসী ও দৌলতপুরী নামে তিনটি মুখিকচুর জাত, কলা ও আনারস উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি, রাইজোবিয়াম জৈব সার উৎপাদন প্রযুক্তি, সয়েল টেস্টিং কিট, পেয়ারাগাছের মড়ক নিবারণ পদ্ধতি, বীজের স্বাস্থ্য পরীক্ষার সহজ পদ্ধতি, অ্যারোবিক পদ্ধতিতে ধান চাষ প্রযুক্তি, শুকানো পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ, পশুখাদ্য হিসেবে ভুট্টা উৎপাদন বৃদ্ধির কলাকৌশলসহ আরও অসংখ্য প্রযুক্তি ও কৌশল উদ্ভাবন করেছে।
গবেষণায় এত ব্যাপক অবদান রাখায় ২০১৭ সালে ওয়েবমেট্রিকস র‌্যাঙ্কিং অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিসে বাংলাদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জার্মপ্লাজম সেন্টারের মাধ্যমে কৃষি গবেষণায় ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪১৯’ স্বর্ণপদক লাভ করে।
১৯৭১ সালের অসহযোগ ও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

অধ্যাপক লুৎফুল হাসান
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ