কেতাদুরস্ত মুশতাক ছিলেন পুরোদস্তুর বোহিমিয়ান

কুমিরের খামারে সস্ত্রীক মুশতাক আহমেদ
ফাইল ছবি

আট-দশটা তরুণের মতো কোনো প্রথাগত পেশা বা উদ্যোগে আগ্রহ ছিল না মুশতাক আহমেদের। পড়াশোনা থেকে চাকরি বা উদ্যোগ—সবকিছুতেই বৈচিত্র্য খুঁজতেন তিনি। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সফল কুমির খামার গড়ে তোলার পর ‘কুমির ভাই’ হিসেবে বন্ধু আর স্বজনদের মাঝে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কিন্তু এর বাইরেও ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র হিসেবে বনানীর ক্যাডেট কলেজ ক্লাবের তুমুল আড্ডাবাজ, বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করা তরুণদের তথ্য গবেষণার অন্যতম উৎস ছিলেন তিনি।

ভালুকায় কুমির খামার গড়ে তা থেকে আবার সরে এলেও বন্য প্রাণী নিয়ে নিত্যনতুন উদ্যোগে তিনি সক্রিয় ছিলেন।

গ্রেপ্তার হওয়ার আগে কয়েক বন্ধু মিলে দেশে বন্য প্রাণীদের ‘অ্যামিউজমেন্ট পার্ক’ গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তিনি। সেটার নকশা, পরিকল্পনা আর অর্থায়ন নিয়ে কয়েক বছর ধরে ব্যস্ত ছিলেন এই স্বপ্নবাজ। এর ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুকে নানা বিষয় নিয়ে লেখা, ছবি দেওয়া আর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করতেন। কুমির মানবের নিত্যদিনের সমস্যা নিয়ে আঁকা জাপানি কার্টুনিস্ট কেইজোর কার্টুন ছিল তাঁর প্রিয়। ওই কার্টুনগুলোকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তুলনা করে ব্যঙ্গাত্মক ক্যাপশন দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করতেন মুশতাক আহমেদ।

পোশাক–আশাকে টিপটপ-কেতাদুরস্ত মুশতাক আহমেদের ভেতরটা ছিল পুরোদস্তুর বোহিমিয়ান। জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন লীপা আক্তারকে। মুশতাকের সব ধরনের পাগলামিতে তাঁর সায় ছিল। বলা যায়, তিনি স্বামীর এসব উদ্যোগে সায় তো দিতেনই, উল্টো সঙ্গীও হতেন। প্রাণিবিদ্যার ছাত্রী রীতা নিজেও মুক্তা চাষ ও ইলিশ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। কুমির খামার গড়তে চাচাতো ভাই, এক মামা, লীপাসহ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নেমেছিলেন। ২০১০ সালের ৪ জুন বাংলাদেশ থেকে তাঁর হাত ধরেই প্রথমবারের মতো কুমির রপ্তানি হয়। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণার কাজে ৬৩টি ছোট–বড় কুমির রপ্তানি করেন তিনি।

কুমিরচাষি হিসেবে জীবন শুরু করার আগে মুশতাক আহমেদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি ছিল একদম ভিন্ন। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। এরপর সিএ করেন। পেশা হিসেবে বেছে নেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার সোনা-রুপা চা–বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপকের। সুন্দরবনে চাকরিসূত্রে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে গিয়ে পড়াশোনার চেয়ে কৃষি খামারে ঘোরার নেশায় পেয়ে বসে তাঁকে।

১৯৯৫ সালে দেশে ফিরে শুরুতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরে যোগ দেন। কর্মক্ষেত্র হিসেবে ছিল কক্সবাজারের টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। সেখানে দুই বছর কাজ করার পর ওই সময়ের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ইন্টারনেটভিত্তিক টেলিফোন সেবা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন তিনি।

এরপর ২০০১ সালে বোট ম্যানেজার হিসেবে গাইড ট্যুরসে যোগ দেন। সেখানে কাজের সুবাদে কাছ থেকে দেখেন সুন্দরবনকে। সেখান থেকে তাঁর কুমিরের খামার গড়ে তোলার চিন্তা মাথায় আসে। ভালুকার ‘রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড’ হলো দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির খামার। কাজ শুরুর পর থেকেই এ নিয়ে গবেষণা বা অন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকেই সবকিছু টুকে রাখতেন মুশতাক। নিজের অভিজ্ঞতা এবং টুকে রাখা তথ্যের ভিত্তিতেই প্রথম বই প্রকাশ করেন।

একপর্যায়ে ২০১৪ সালে খামারের মালিকানা ছেড়ে দেন মুশতাক আহমেদ। নিজের প্রতিষ্ঠা করা সেই কুমিরের খামারটি এখন ধুঁকে ধুঁকে চলছে। ৭৪টি কুমির নিয়ে শুরু হওয়া ওই খামারে এখন প্রায় আড়াই হাজার কুমির থাকলেও সেগুলোর বেশির ভাগ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। খামারের বর্তমান মালিক প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) বিদেশে পলাতক। ময়মনসিংহের ভালুকায় গড়ে ওঠা ওই খামারে কুমিরগুলো যে ডিম দেয়, তা ফেলে দেওয়া হয়। কুমিরগুলোকে কোনো খাবারও দেওয়া হচ্ছে না। তাই কুমির আর বাড়াতে চান না সেখানকার তত্ত্বাবধায়কেরা।