কোমরের বেল্ট খুলে মাটিতে রাখল পাকিস্তানি সেনারা

একাত্তরের নভেম্বর থেকে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে। আজ পড়ুন বগুড়ার কাহি।।

একাত্তরের ১৮ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করছেন পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ

১৪ িডসেম্বর বগুড়া শহরের চারদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী। সুরক্ষিত অবস্থানে থেকে পাকিস্তানি সেনারা প্রতি-আক্রমণ চালায়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। চার দিনের মাথায় থামে সে লড়াই। আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানিরা।
মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার হামিদুল হোসেন তারেক বীর বিক্রমের আলাপচারিতায় উঠে এসেছে আত্মসমর্পণের সেই দিনটির কথা। তিনি বললেন, শহরের সুবিলের সিঅ্যান্ডবি রেস্টহাউস থেকে পুলিশ লাইনস পর্যন্ত শত্রুপক্ষের ঘাঁটি। বাসাবাড়ির ছাদে বালুর বস্তা আর রাস্তায় বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি সেনারা। ১৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ শুরু করেন। বগুড়ার আকাশে ওই দিন ওড়ে মিত্রবাহিনীর মিগ-২১ যুদ্ধবিমান। শত্রুপক্ষের অবস্থান লক্ষ্য করে বোমা ফেলা হয়। গোটা শহর কেঁপে ওঠে। যৌথ বাহিনীর আক্রমণের মুখে সুবিল রেস্টহাউস, আজিজুল হক ও মহিলা কলেজ ছেড়ে কটনমিল এলাকায় অবস্থান নেয় পাকিস্তানিরা।

১৫ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে চতুর্মুখী আক্রমণ শুরু করে। দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। ‘শহরের পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ চালাতে মিত্রবাহিনীকে গাইড করার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর,’ বললেন হামিদুল হোসেন। ‘রেলস্টেশন দখলের পর সাতমাথার দিকে এগোতেই শত্রুপক্ষের রকেট লাঞ্চার এসে পড়ল ট্যাংকের সামনে। পাল্টা আক্রমণের মুখে জিলা স্কুলে পালাল ১০-১২ জন পাকিস্তানি সেনা। ধরা পড়ার পর তারা আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে বগুড়া জিলা স্কুলে ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।’
১৮ ডিসেম্বর বগুড়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হামিদুল হোসেন তারেক বীরবিক্রম। তিনি বলেন, ‘কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। পুলিশ লাইনে ক্যাম্প করেছিলাম আমরা। সকাল আটটায় খবর এল পাকিস্তানি বাহিনী আজ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবে। ১১টায় সুবিল রেস্টহাউসে মিত্রবাহিনীর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে পৌঁছালাম। বিকেল সাড়ে চারটায় ঘনিয়ে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মিত্রবাহিনীর সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমিও সেখানে উপস্থিত। যুদ্ধবন্দী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৬ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহকে নাটোর থেকে ইতিমধ্যেই আনা হয়েছে। রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকেও যুদ্ধবন্দী কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে আসা হয়েছে। আজিজুল হক কলেজের পুরোনো ভবন-সংলগ্ন ফুলবাড়ি মাঠের মাঝখানে চাদরে ঢাকা একটি টেবিল। টেবিলের একপাশে দাঁড়িয়ে ২০ মাউনটেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল লচমন সিংসহ মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা। আর অন্য পাশে যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানি সেনারা। বিউগল বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ও পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক সামরিক কায়দায় টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন।

বিউগলের সুর থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিত্রবাহিনীর গোর্খা প্লাটুন সামরিক কায়দায় রাইফেল তুলে ধরল। নজর হোসেন শাহ তখন কোমর থেকে রিভলবার বের করে দুই হাতে তা মিত্রবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল লচমন সিংয়ের সামনে বাড়িয়ে ধরলেন। লচমন সিং রিভলবারটি নিয়ে টেবিলে রেখে দিলেন। তখন সারিবদ্ধ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা কোমরের বেল্ট খুলে মাটিতে রাখলেন। দুজন সৈনিক সামরিক কায়দায় আত্মসমর্পণের লিখিত দলিল এনে টেবিলে রাখলেন। সেই দলিলে পরপর সই করলেন দুই অধিনায়ক। এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ পর্বের।’
বগুড়ায় সেদিন পাঁচজন পাকিস্তানি অফিসার, ৫৬ জন জেসিও, ১ হাজার ৬১৩ জন বিভিন্ন পদের কর্মকর্তা ও ৩৩ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযুদ্ধকালে ইস্টার্ন জোনের ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিংয়ের লেখা ইন্ডিয়াস ওয়ারস সিন্স ইনডিপেনডেন্টস: দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ (ভলিউম: ওয়ান) বইয়ে এ তথ্যের উল্লেখ রয়েছে।

মিত্রবাহিনীর বগুড়া আক্রমণের স্মৃতিচারণা করলেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ৭১-এর বগুড়ার সভাপতি মাসুদার রহমান । প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মিত্রবাহিনী হিলি থেকে বগুড়ার দিকে রওনা দেয়। পথে মহাস্থানগড়ে ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলে সম্মুখযুদ্ধ বাধে। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর চারজন সৈনিক মারা যান। ১৪ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে বগুড়া অভিমুখে রওনা হয় মিত্রবাহিনী।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন বগুড়া প্রতিনিধি আনোয়ার পারভেজ)