কোটালীপাড়ায় জ্ঞানের আলো পাঠাগার

বিভিন্ন বয়সের পাঠকে মুখর থাকে পাঠকক্ষ। চলে সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজনছবি: প্রথম আলো

শুধু জ্ঞান আহরণের জন্যই পাঠাগার—এমন ধারণা বদলে দিয়েছে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার ‘জ্ঞানের আলো পাঠাগার’। পাঠকক্ষ থেকে মানবসেবার অনন্য এক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে এ পাঠাগার। পাঠাগারটি এর কার্যক্রমের মাধ্যমে উপজেলাবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। পাঠদান, দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তা, জটিল রোগে আক্রান্ত অসহায় রোগীর চিকিৎসা ও পুনর্বাসন, দরিদ্র মানুষকে খাদ্য-বস্ত্র বিতরণ ছাড়াও যেকোনো দুর্যোগ-মহামারির সময় আশার আলো হয়ে মানুষের পাশে থেকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় জ্ঞানের আলো পাঠাগার।

২০১৪ সালে মায়ের দেওয়া ২ শতাংশ জায়গায় মনিরুজ্জামান জুয়েল নামের এক তরুণ বন্ধুদের নিয়ে এলাকায় একটি পাঠাগার গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। প্রিয় গ্রামটি হবে স্বপ্নের মতো, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবে গ্রামের মানুষ—এমন স্বপ্ন নিয়ে জুয়েল ওই জমিতে ঘর তৈরি করেন। ২০১৭ সালের ২৭ জুন আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে জ্ঞানের আলো পাঠাগার।

বর্তমানে এলাকার শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন পাঠাগারে এসে বই, দৈনিক পত্রিকা ও বিভিন্ন সাময়িকী পড়ে জ্ঞান লাভ করছে। এলাকার শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে নিয়মিতভাবে বইপড়া উৎসব, সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, দেশাত্মবোধক সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন, এলাকার দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ এবং কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনার আয়োজন করে জ্ঞানের আলো পাঠাগার।

প্রতিবছর দরিদ্র শিক্ষার্থীদের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের স্কুলড্রেস ও শিক্ষা–উপকরণ দেওয়া হয় পাঠাগারটির উদ্যোগে। শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে জ্ঞানের আলো পাঠাগার। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঠাগারটি এলাকায় মাদক, জঙ্গিবাদ ও যৌন হয়রানি–বিরোধী সেমিনার ও প্রজেক্টরের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতামূলক ভিডিও প্রদর্শনীর আয়োজন করে আসছে। উপজেলায় উন্নয়ন মেলা, মাদকবিরোধীসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক সভা, সেমিনার ও র‍্যালিতে জ্ঞানের আলো পাঠাগারের থাকে সরব উপস্থিতি।

জ্ঞানের আলো পাঠাগারের নিয়মিত সদস্য এখন ৩৫ জন। আর বিভিন্ন ইউনিয়ন মিলিয়ে স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন ২০৮ জন।

উপজেলায় রক্তের অভাবে কোনো রোগীকে এখন আর চিন্তায় পড়তে হয় না। জ্ঞানের আলো পাঠাগারের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে ‘জ্ঞানের আলো পাঠাগার ব্লাড ডোনার ক্লাব’। স্বেচ্ছায় রক্তদানে আগ্রহী তরুণদের নিয়ে ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করে এটি পরিচালিত হয়। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সবাইকে রক্তের গ্রুপ জানিয়ে দেয় সংগঠনটি।

সেলুনে চুল কাটাতে গিয়ে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। সেই সময়টুকু সবাই যেন বই পড়ে কাটাতে পারে, সে জন্য ইতিমধ্যে উপজেলার ১০টি সেলুনে মিনি পাঠাগার স্থাপন করেছে জ্ঞানের আলো পাঠাগার। যা স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধে৵ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অনেকেই আগ্রহ নিয়ে সেলুনে বসে বই পড়ছেন।

করোনাকালে টিম ‘লাইফ সাপোর্ট’

করোনার মহামারিতে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে জ্ঞানের আলো পাঠাগার গঠন করে টিম ‘লাইফ সাপোর্ট’। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য ২৪টি অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহ করে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা বিনা মূল্যে অক্সিজেন সেবা দিয়েছেন।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিকে আপনজন ফেলে পালিয়ে গেছেন, সৎকারে এগিয়ে আসেননি কেউ; তখন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সম্পন্ন করেছে জ্ঞানের আলো পাঠাগারের স্বেচ্ছাসেবী দল। এ ছাড়া করোনা প্রতিরোধে উপজেলা প্রশাসনের কাজেও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে আসছে এ দলটি। বিনা মূল্যে মাস্ক ও লিফলেট বিতরণ, সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে উদ্বুদ্ধ করা, দরিদ্র মানুষকে খাদ্যসামগ্রী দেওয়াসহ ধান কেটে কৃষকের বাড়ি পৌঁছানোর কাজ করেছেন জ্ঞানের আলো পাঠাগারের সদস্যরা।

অসহায়দের জন্য ‘ক্রাউডফান্ডিং’

সড়ক দুর্ঘটনায় চার বছরের শিশু হালিমা ও তার দরিদ্র দিনমজুর বাবা গুরুতর আহত হন। অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় চিকিৎসা। তখন এগিয়ে আসেন জ্ঞানের আলো পাঠাগারের সদস্যরা। তাঁরা চিকিৎসার জন্য সংগ্রহ করেন ১ লাখ ২০ হাজার ৩১ টাকা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা প্লাস্টিক সার্জারি অ্যান্ড বার্ন ইউনিটে চিকিৎসায় খরচ হয় ৬৫ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ৫৫ হাজার ৩১ টাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপস্থিতিতে তুলে দেওয়া হয় শিশুটির পরিবারের হাতে।

ওয়েস্ট কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনের এসএসসি পরীক্ষার্থী মুন্না শেখের ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে। দরিদ্র পরিবার ছেলের মরণঘাতী চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহে নিরুপায় তখন পাশে দাঁড়ায় জ্ঞানের আলো পাঠাগার। ফেসবুকে আর্থিক সহায়তা চেয়ে সংগ্রহ করে ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৬৯০ টাকা। প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসা তহবিল থেকে সংগ্রহ করে ৫০ হাজার টাকা। চিকিৎসা শেষে কোটালীপাড়া থানার ওসির উপস্থিতিতে অবশিষ্ট ১ লাখ ৯৪ হাজার ৬৯০ টাকা মুন্নার ভবিষ্যতের জন্য পরিবারের হাতে তুলে দেন পাঠাগারের সদস্যরা। মুন্না এবার অংশ নেবে এসএসসি পরীক্ষায়।

চানাচুর কারখানার ২২ বছর বয়সী হতদরিদ্র এতিম দশরথ দাসের হঠাৎ ধরা পড়ে ব্রেন টিউমার ও হরমোন সংকট রোগ। অন্ধকার নেমে আসে পরিবারে। আত্মীয়-স্বজনেরাও মুখ ফিরিয়ে নেন। ঠিক তখন এগিয়ে আসে জ্ঞানের আলো পাঠাগারের সদস্যরা। ফেসবুকের মাধ্যমে সংগ্রহ করে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। চিকিৎসা শেষে জ্ঞানের আলো পাঠাগার উপজেলা প্রশাসনের উপস্থিতিতে নগদ এক লাখ টাকা ও আয়ের মাধ্যম হিসেবে একটি ওজন মাপার ডিজিটাল মেশিন তুলে দেয় দশরথের হাতে।

কোটালীপাড়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামের কৃষক সলেমান দাড়িয়ার ছেলে মাওলানা শামসুল হকের দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। মা রাহেলা বেগম নিজের একটি কিডনি সন্তানকে দান করতে সম্মত হন। কিন্তু টাকার অভাবে হচ্ছিল না কিডনি প্রতিস্থাপন। ফেসবুকের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে কিডনি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করা হয়। চিকিৎসা শেষে আরও ৭৫ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয় শামসুল হকের হাতে।

কোটালীপাড়ার তারাশী গ্রামের শহীদুল ইসলাম এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে অটোভ্যান কিনে তা চালিয়ে সংসার চালাতেন। ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়ে খোয়াতে হয় সেই অটোভ্যান। একদিকে ঋণের কিস্তির টাকা সংগ্রহ, অন্যদিকে ছয় সদস্যের সংসারের খরচ জোগাতে দিশেহারা হয়ে পড়েন শহীদুল। বিষয়টি জানার পর জ্ঞানের আলো পাঠাগারের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট দেন পাঠাগারের সদস্যরা। ফেসবুকের মাধ্যমে জমা হয় ৪৬ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়ে তাঁরা অটোভ্যান ও একটি সেলাই মেশিন কিনে দেন শহীদুলকে। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে শহিদুলের এখন সুখের সংসার।

স্বামীর অকাল মৃত্যুতে তারাশী গ্রামের তাজনেহার ও সাদিয়া বেগমের দিশেহারা হয়ে দিন কাটছিল। তাঁদের তিনটি করে ছাগল ও হাঁস-মুরগি এবং ছাগল পালনের জন্য ঘর তুলে দেন পাঠাগারের সদস্যরা। এমন অসংখ্য মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সংগঠনটি।

এ ছাড়া প্রতিবছর ঈদুল ফিতর ও দুর্গাপূজায় দরিদ্র পরিবারে নতুন পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ এবং শীতের সময় শীতবস্ত্র বিতরণ করে আসছে জ্ঞানের আলো পাঠাগার।

পাঠাগারের সভাপতি সুশান্ত মণ্ডল বলেন, আজকের তরুণেরাই আগামীর শক্তি। দিন দিন মোবাইল গেমসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর আসক্তিতে ঝুঁকে পড়ছে বর্তমান তরুণ সমাজ। এই তরুণ সমাজ যেন সামাজিক অবক্ষয় থেকে মুক্ত থাকে, সেজন্য প্রয়োজন পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্যে চালু করা হয়েছে ‘জ্ঞানের আলো ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি’। এলাকার জনসাধারণের ভেতর সচেতনতা বৃদ্ধি, মানবিক গুণাবলি ও ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরির মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তোলাই জ্ঞানের আলো পাঠাগারের লক্ষ্য।

কোটালীপাড়ার ইউএনও ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন ধরনের কাজে স্বেচ্ছাসেবকের প্রয়োজনে জ্ঞানের আলো পাঠাগারের সদস্যরা অংশ নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই পাঠাগারের কার্যক্রম খুবই প্রশংসনীয়। সমাজসেবামূলক এ ধরনের কাজে সম্পৃক্ত থাকার মাধ্যমে যুবসমাজকে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অবক্ষয় থেকে দূরে রাখার এ উদ্যোগ একটি রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।