কোভিড-১৯: আসুন, আপনি-আমি প্রস্তুত হই

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

দিনের পর দিন যেভাবে করোনাভাইরাস একের পর এক মানুষের জীবন-জীবিকায় থাবা বসিয়ে চলেছে, মনে হচ্ছে এই ভাইরাস আমাদের কাউকেই ছাড়বে না। আতঙ্কের মধ্যেই ৩১ মে থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে সাধারণ ছুটি। তুলে নেওয়া হচ্ছে তথাকথিত লকডাউন; খুলেছে সব অফিস, আদালত, কলকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। চলছে গণপরিবহনও। এতে প্রকারান্তরে এই ভাইরাস ডালপালা মেলার সব উপায়-উপকরণ পেয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদেরই বোধ হয় এই অদৃশ্য শত্রুর হামলায় আক্রান্ত হতে হবে।

ইতিমধ্যে আমরা অনেকেই হয়তোবা আক্রান্ত হয়েই আছি, কিন্তু কোনো লক্ষণ না থাকায় আমরা টেস্ট করাচ্ছি না এবং তাই আমরা আক্রান্তের তালিকায় যুক্ত হচ্ছি না। আবার অনেকেই টেস্ট করার সুযোগ পাচ্ছেন না বা কেউ কেউ ইচ্ছা করেই টেস্ট করাচ্ছেন না। তাই করোনা আক্রান্তের যে তালিকা দেওয়া হচ্ছে, তাতে প্রকৃত সংখ্যা প্রতিফলিত হয়তো হচ্ছে না। প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা প্রকাশিত সংখ্যার কয়েক গুণও হতে পারে।
এই ভাইরাসে আক্রান্তের ঝুঁকি ও মৃত্যুর হাতছানি সত্ত্বেও জীবিকার তাগিদে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে আবারও ব্যস্ত আমরা। এ কারণে সামাজিক দূরত্বের ধারণা পুরোপুরি আর টেকানো যাবে না। ফলে এই ভাইরাস বংশবিস্তারের মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। পরিণামে অদৃশ্য এই ভাইরাসে যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারি আমি, আপনিও। তাই আসুন, কিছুটা সময় থাকতেই আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের যথাসম্ভব প্রতিরোধ ও প্রতিকারব্যবস্থা গ্রহণ করি। যেমন:
#
পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে, আপনার দুই বা তিন রুমের বাসার একটি রুমকে কীভাবে আইসোলেশনের জন্য আলাদাভাবে ব্যবহার করবেন, সেটি ভেবে রাখুন।
#
করোনার লক্ষণ দেখা দিলে, নিকটস্থ কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে তার নমুনা পরীক্ষা করাবেন, তাদের কয়েকটির নাম ও টেলিফোন বা মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহে রাখুন।
#
প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরামর্শ পেতে corona.gov.bd ওয়েবসাইটে নির্দেশিত হটলাইন নম্বরগুলো সংগ্রহে রাখুন এবং নিয়মিত এই সাইটটি ভিজিট করুন। পাশাপাশি আপনার নিকটস্থ সরকারি জেলা বা উপজেলা হাসপাতালে যোগাযোগ ও পরামর্শের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের টেলিফোন বা মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহে রাখুন।

#
করোনা পজিটিভ হলে এবং হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সরকার নির্দিষ্ট নিকটস্থ কোন হাসপাতালে ভর্তি হবেন, তাদের দুই-তিনটির নাম ও টেলিফোন বা মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহে রাখুন।
#
যেকোনো জরুরি অবস্থায় দ্রুততম সময়ে হাসপাতালে পৌঁছা নিশ্চিত করতে অন্তত তিনটি অ্যাম্বুলেন্সের নাম ও টেলিফোন বা মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহে রাখুন।
#
যেকোনো বিপদ মহাবিপদে রূপ নেবে, যদি আপনার হাতে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকে। তাই আসন্ন অসুস্থতা এবং তার সর্বোচ্চ চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে নিজের হাতে বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চিত রাখুন, যেন জরুরি সময়ে মানুষের কাছ ছোটাছুটি করতে গিয়ে চিকিৎসা বিলম্বিত না হয়।
#
আপনি অসুস্থ হলে পরিবারের বা নিকট স্বজনদের কে আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, কে আপনার পাশে থেকে সেবা করবে, সে বিষয়ে একটি ঘরোয়া আলাপচারিতা সেরে রাখুন।
#
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা পেতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হলে, অ্যাম্বুলেন্স না পেলে, খাদ্য ও ওষুধ না পেলে কিংবা প্রতিবেশীদের অবজ্ঞা ও হয়রানির শিকার হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের (ইউএনও, এসি ল্যান্ড, ওসি) জানাবেন। তাই তাঁদের মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহে রাখুন এবং যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁদের ফোন করে অবগত করবেন এবং সহায়তা চাইবেন।

#
মনে রাখবেন, সব সময়ে আপনার বিপদ ও সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা প্রচারের অন্যতম বন্ধু হচ্ছেন সংবাদকর্মীরা। তাই দু-একজন পত্রিকা ও টেলিভিশন রিপোর্টারের নাম ও মুঠোফোন নম্বরও সংগ্রহে রাখুন। নিজের দুর্ভোগ, প্রশাসন বা প্রতিবেশীদের যেকোনো অসহযোগিতার কথা তাঁদের জানান। প্রয়োজনে পত্রিকা বা টেলিভিশন অফিসেও ফোন ও যোগাযোগ করতে তাদের স্থানীয় ও প্রধান কার্যালয়ের ফোন নম্বর এবং ই–মেইলও সংগ্রহে রাখতে পারেন।

#

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

করোনার যেহেতু এখনো কোনো কার্যকর ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, প্রতিরোধই এর একমাত্র ব্রহ্মাস্ত্র। তাই করোনা মোকাবিলা করার জন্য আমাদের প্রত্যেককেই মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। আমাদের শরীরকে প্রস্তুত করার পাশাপাশি আমাদের মানসিকভাবেও শক্ত হতে হবে। অনেকেই মানসিক শক্তি ধরে রাখাটাই করোনা মোকাবিলার বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন। দুশ্চিন্তা আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তা ছাড়া দুশ্চিন্তার কারণে কোনো কোনো বিপদের কারণ হতে পারে। আমাদের অতিরিক্ত এই দুশ্চিন্তা ও ভয় একটা পক্ষকে ‘ভয়ের ব্যবসা’ করার সুযোগও তৈরি করে দিচ্ছে। তাই নিজের মানসিক মনোবল বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিবেশী বা পরিচিত আক্রান্ত ব্যক্তিটিকেও মানসিকভাবে চাঙা রাখা, সাহস জোগানোটাও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তাই কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাঁকে অবজ্ঞা না করে নিয়মিত তাঁর খোঁজখবর রাখুন এবং তাঁকে সর্বাত্মক মানসিক, সামাজিক, আর্থিক ও চিকিৎসা সহায়তা দিন। তবে তিনি যদি আইসোলেশনে না থাকেন কিংবা স্বাস্থ্যবিধি না মানেন, তবে তা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সংবাদকর্মীদের জানান।

#
এখন দেশে করোনাভাইরাসের উর্বর সময় চলছে। কিন্তু এই সময়ে এসে লকডাউন তুলে সবকিছু খুলে দেওয়া হচ্ছে। এ যেন দেশের মানুষকে উত্তপ্ত কড়াইয়ের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশে কয় মাস আর ঘরে বসে অন্ন জুটবে! তাই আমাদের এখন একসঙ্গে করোনাযুদ্ধ ও জীবনযুদ্ধ দুটোই চালিয়ে যেতে হবে। কোনোটিকেই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাই অতিঝুঁকিপূর্ণ এই সময়ে জীবিকায় নামার পাশাপাশি নিজের ও নিজের পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে গেছে বহুগুণ। ইতিমধ্যে আমরা নিশ্চয় জেনেও গেছি, সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি; সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে বারবার হাত ধোয়া; স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করা; মুখে মাস্ক পরা; হাঁচি, কাশি ও থুতুর শিষ্টাচার সম্পর্কে। তাই আসুন, প্রত্যেকেই সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি।

#
স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি নিজেদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সচেষ্ট হই। তাই অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (ধূমপান, ভাজাপোড়া, চিনি ইত্যাদি খাওয়া) পরিত্যাগ করি এবং বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করি।
মনে রাখবেন, দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটি মানুষ করোনাভাইরাসে মারা গেলেও দেশ, দেশের সরকার, অর্থনীতি, রাজনীতি সবই ঠিক থাকবে; কিন্তু আপনি মারা গেলে আপনার ও আপনার পরিবারের সব শেষ হয়ে যাবে। তাই নিজের ভালোটা নিজেকেই ভাবতে হবে, নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে।

* ব্যবস্থাপক, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, পাকুন্দিয়া শাখা, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ। [email protected]