কোরআনে হাফেজ উসামার নেশা ক্যালিগ্রাফি

মাস ছয়েক আগে বিয়ে করেছেন উসামা হক ও জান্নাতুল ফেরদৌস। রাজধানীর আজিমপুরে নতুন সংসারে আসবাবের বাহুল্য নেই বললেই চলে। তবে ছোট বাসার আনাচে-কানাচে নানা আকৃতির ছবির ফ্রেম। এগুলো সবই ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা। এর মধ্যে কোনোটি গ্রাহকের কাছে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আবার কোনোটিতে আঁকাআঁকি শুরু হয়েছে মাত্র। উসামা জানালেন, তাঁর নেশা ও পেশা এই ক্যালিগ্রাফি বা অক্ষরশিল্প।

উসামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগ থেকে স্নাতক করেছেন। তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী। জান্নাতুল বললেন, নিজেদের পছন্দের পর পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়েছে। উসামার নেশা ও পেশা নিয়ে জান্নাতুলের পরিবারের বেশ আপত্তি ছিল। তবে এখন ধীরে ধীরে সবাই মেনে নিচ্ছেন। আর জান্নাতুল নিজে চান, উসামা এ শিল্পটি নিয়েই থাকুন, হয়তো প্রতি মাসের আর্থিক নিশ্চয়তায় টান পড়বে, কিন্তু শখের কাজ থেকে সরে আসতে হবে না। অন্য কোনো চাকরিতে ঢুকলে এ শিল্পটিকে হাতছাড়া করতে হবে। কেননা, এ শিল্পের পেছনে শ্রম ও সময় দিতে হচ্ছে। একেকটি কাজ শেষ করতেই ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লেগে যায়। কাজ বড় হলে সময়টাও বাড়তে থাকে।

গ্রিক ‘ক্যালোস’ শব্দ থেকে ‘ক্যালিগ্রাফি’ শব্দের উৎপত্তি। এর শাব্দিক অর্থ ‘সুন্দর লেখা’। উসামা মাদ্রাসায় পড়েছেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কোরআনে হাফেজ হওয়ায় উসামার আরবি লিখতে ভালো লাগে। ক্যালিগ্রাফির শখও ছিল। এখন এ মাধ্যমকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর অনলাইনে অন্যদের ক্যালিগ্রাফি শেখানো শুরু করেন। এ থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে দুজনের মাসিক খরচ চলে যাচ্ছে। মানুষের প্রশংসাও পাচ্ছেন। উসামা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকায় ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং বিক্রি করেছেন। তবে সম্প্রতি তিনি এক লাখ টাকার একটি পেইন্টিংয়ের ফরমাশ পেয়েছেন।

উসামা আরবি ক্যালিগ্রাফি বেশি করেন
ছবি: সংগৃহীত


সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ডেস্ক ক্যালেন্ডারেও জায়গা করে নিয়েছে উসামার ক্যালিগ্রাফি। জাতীয় শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ চারুশিল্পী পরিষদ, মইনিয়া ফাউন্ডেশন, ২০১১ সালে প্রথম জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ইসলামিক আর্ট দিবস, আন্তর্জাতিক শীতকালীন আর্ট ফেস্টিভ্যালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতেও অংশ নিয়েছেন উসামা। সৌদি আরব, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে উসামার কাজ পৌঁছে গেছে।

মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে ক্যালিগ্রাফি চর্চা শুরু করেন উসামা। জানালেন, তিনি যে মাদ্রাসায় পড়তেন সেখানে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় শেখানো হতো। ক্যালিগ্রাফিতে আগ্রহ দেখান উসামা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যালিগ্রাফি করছেন বা আগ্রহ আছে, এমন কাউকে সেভাবে পাননি। উসামা নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে চান, চর্চার পর এখন নিজেই অন্যদের শেখাচ্ছেন। তবে তাঁর ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই।

উসামা বললেন, ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ের একটি ধারা। তিনি বাংলা, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় ক্যালিগ্রাফি করেন। বিভিন্ন প্রদর্শনীতে বাংলা ক্যালিগ্রাফির কদর বেশি। তবে উসামা আরবি ক্যালিগ্রাফি বেশি করেন বা এতেই তিনি বেশি দক্ষ। লেখাটা যাতে সুন্দর হয়, সে চেষ্টা থাকে সব সময়।

উসামার করা বাংলা ভাষার একটি ক্যালিগ্রাফি
ছবি: সংগৃহীত

উসামা বললেন, ইন্টারনেটের যুগ, সবাই বিশ্বের বিভিন্ন তথ্য জানতে পারছেন। বিদেশে বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশে বাসা সাজানো হয় ক্যালিগ্রাফি দিয়ে। তা দেখেও অনেকে উৎসাহিত হচ্ছেন। ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং শুধু লেখা নয়। রং, তুলির খেলা বা শিল্প। হরফ বা শব্দ দিয়ে কম্পোজিশন তৈরি করে রংতুলি দিয়ে তা প্রকাশ করা হচ্ছে।
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত বা বাক্যের পাশাপাশি বর-কনের নাম লিখে ‘কাপল নেম ক্যালিগ্রাফি’ করেন উসামা। তিনি বলেন, বিয়েতে এ ধরনের বিশেষ উপহার পেয়ে বর ও কনে অনেক খুশি হন।

উসামার ভাষ্য, দেশে ক্যালিগ্রাফিশিল্পের সম্ভাবনা আছে। ক্যালিগ্রাফার বা ক্যালিগ্রাফিশিল্পীর সংখ্যা যত বেশি থাকবে, তত শিল্পের প্রসার ঘটবে। বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। উসামা এ শিল্পের মাধ্যমেই বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে চান। মৃত্যুর পরও এই শিল্পের মাধ্যমেই বেঁচে থাকতে চান।

উসামা’স ক্যালিগ্রাফি নামে ফেসবুক পেজ ও উসামা হক নামের ইউটিউব চ্যানেল আছে উসামার। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তিনি ক্রেতাদের কাছ থেকে ফরমাশ নেন। আর ইউটিউব চ্যানেলে ক্যালিগ্রাফির ভিডিও শেয়ার করেন।

ক্যালিগ্রাফি নিয়ে এই পর্যন্ত আসার পেছনে আরেক শখের ক্যালিগ্রাফিশিল্পী ও প্রশিক্ষক মাহবুব মুর্শিদের কথা উল্লেখ করলেন উসামা।

মাহবুব মুর্শিদ প্রথম আলোকে বলেন, ক্যালিগ্রাফির প্রচার বা প্রসার এখনো অনেক কম। তবে এ শিল্পের সম্ভাবনা অনেক। জানালেন, তিনি আঁকাআঁকি করতেন। পরে শখের বশেই এ শিল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। ইরান, কাতার, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন। ২০১৮ সাল থেকে নিজেই বাণিজ্যিকভাবে এ শিল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। এ পর্যন্ত ১২টি কর্মশালা করেছেন। এসব কর্মশালা থেকে প্রশিক্ষিত শিল্পীর সংখ্যা ৭০০ থেকে ৮০০ জন। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর অনেকে আবার অন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এভাবেই এ শিল্পের প্রসার ঘটছে।

মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে ক্যালিগ্রাফি চর্চা শুরু করেন উসামা
ছবি: মানসুরা হোসাইন

মাহবুব মুর্শিদ জানালেন, গড়ে তাঁর ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনোটা সাড়ে তিন লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে।