কোরবানির একাল-সেকাল

গরুর হাটের এই চিত্র সবার পরিচিত।
ছবি: প্রথম আলো

আমরা রোজগেরে হওয়ার পর থেকে প্রতিবছর কোরবানির ঈদের দু-তিন মাস আগে থেকেই মা মহা জ্বালাতন শুরু করতেন, কোরবানির ব্যাপারে কী করলাম। তাঁকে যতই বোঝাই, প্রতিবছর যা হয়েছে, এবারও সেটাই হবে, এত আগে থেকে এটা নিয়ে ভাবার কিছু নেই; তবু তাঁর মন থেকে দুশ্চিন্তা যায় না। আগেভাগে চালের গুঁড়া করার জন্য বাড়িতে কাজ করা বানুর মা, ছেনুর মাদের তাগাদা দেওয়া, ছুরি-বটি শান দিয়ে রাখা—এসব দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে যেত। ঈদের দুদিন আগে হাটে গিয়ে গরু কেনার জন্য চাচা, চাচাতো ভাই, বাড়ির বাঁধা মুনশি—সবাইকে নিয়ে সদলবল হাটে যাওয়া ছিল যেন আরেক পবিত্র কাজ।

হাট বসার কয়েক দিন আগে থেকে সদর রাস্তা দিয়ে জামার কলারের পেছনে ছাতা ঝুলিয়ে ব্যাপারীরা একের পর এক গরুর পাল নিয়ে যেতেন। হাতের লাঠিতে দড়ি বেঁধে ঝোলানো থাকত অনেকগুলো ছোট ছোট টিনের চাকতি। ওদের গলার হাহ্ হাহ্ চিৎকারের সঙ্গে সেই লাঠির তাড়নের ঝনঝন শব্দে সচকিত গরুদের সঙ্গে রাস্তার দুপাশের মানুষও সচেতন হতো যে হাট বসছে।

সেকালে গরুর হাটে গেলে ঢ্যাঙা শিংসর্বস্ব সাদা রঙের যে রাজস্থানি গরুর পাল দেখা যেত, তাদের পালে এখন আর হাওয়া নেই। প্রতিবেশী দেশের গবাদি পশু উৎপাদনকারীদের একসময় পোয়াবারো ছিল, কিন্তু তারা একবারও ভাবেননি, আমাদের খামারি ও গেরস্তরা মিলে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে বসবে। হাটে আমাদের দেশি নানান বর্ণের সুশ্রী হৃষ্ঠপুষ্ট গরুরা এখন ভারতীয় গরু দেখলে সরু চোখে তাকায়।

গ্রামের বাড়িতে কোরবানির যাবতীয় কাজ করত গ্রামের গরিব মানুষেরা, এখনো করে। ঈদের আগের সারা রাত জেগে দরিদ্র বউ-ঝিরা চালের গুঁড়ার রুটি বানাত। রুটির খামির কোলবালিশের মতো করে তারপর সুতার এক প্রান্ত পায়ের আঙুলে জড়িয়ে সেটা দিয়ে কাটা হতো গোল গোল চাকতি, তারপর বেলে নিলেই হয়ে যেত রুটি। একপাশে কাদা লেপা ক্যানেস্ত্রার টিনের সমতল পাতের ওপর সেই রুটি সেঁকা হতো তিন-চারটে চুলোয়। ঈদের জামাত শেষে বাড়ি পৌঁছানোর আগেই দেখতাম, মসজিদের ইমাম সাহেব লম্বা কুর্তার নিচের অংশ কোমরে বেঁধে নিয়ে লম্বা কিরিচ নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি। তারপর গরুর পাশে দাঁড়িয়ে কার কার নামে কোরবানি হবে, কাগজে লেখা সেসব নাম একবার আউড়ে যেতেন বিড়বিড় করে। ততক্ষণে কয়েকজন মিলে গরুটাকে শুইয়ে ফেলেছেন। এ সময় সামনের বাড়ির মধু ভাই খুব হাঁকডাক ছেড়ে ঠিকমতো ‘খোম’ ধরার নির্দেশ দিতেন সবাইকে। ‘খোম’ জিনিসটা যে কী, সেটা তাঁর কাছ থেকে কখনোই জানা হয়নি। জিজ্ঞেস করলেও ঠাট্টা মনে করে কোনো জবাব দিতেন না। ধরে নিতাম খুন, মানে রক্তকেই ‘খোম’ বলতেন তিনি। এ সময় নিরাপদ আড়াল থেকে আমার এক দাদি তাঁর সবচেয়ে কম বয়সী নাতিটাকে বেশ তোয়াজ করে ওর হাতে নারকেলের একটা মালা পাঠিয়ে দিতেন গরুর রক্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য। বড় হয়ে যাওয়া নাতিদের কেউ এ কাজে রাজি হতো না। সেই রক্ত যে তাঁর কী কাজে লাগত, এখনো জানি না।

জবাই করার পর মাংস টুকরা করার কাজে লেগে যেতেন কয়েকজন। বাঁশের বাখারিকে বড় কিরিচের মতো ধারালো করে সেগুলো মাটিতে গেঁথে বটির মতো মাংস কোটার এই চল আজ আর চোখে পড়ে না।

এই সময়ের মধ্যে হিসাব নেওয়া হয়ে গেছে, গ্রামের কয়টি পরিবার কোরবানি দিতে পারেনি। সে অনুযায়ী পাল্লায় মেপে তিন ভাগের এক ভাগ মাংস কলাপাতা বা সটিপাতায় মুড়ে তাদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসা ছিল আরেকটা পবিত্র কর্তব্য। ততক্ষণে কিছু মাংস ভেতরের বাড়িতে আগাম পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রান্না হওয়ামাত্র উঠানে পাটি বিছিয়ে সবাই একসঙ্গে বসত পঙ্‌ক্তি ভোজনে। আজকাল সে পাট উঠে গেছে, বেশি দামের গরু কিনে দাঁতের পাটি দেখিয়ে ওটার দাম জানানোই যেন অনেকের কাছে এখন কোরবানির উদ্দেশ্য। পাল্লা দিয়ে মেপে তিন ভাগের এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া নয়, অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেশি দামের গরু কেনাই এখন রেওয়াজ। কোরবানির মূল ভাবের অভাবই এখন বেশি ভাবায়। এই ধর্মানুষ্ঠানের প্রকৃত অর্থটা ভুলে গিয়ে যে অনর্থ আমরা বাধাই, সেটা যে কত বড় ভুল, যদি বুঝতে পারতাম!