ক্যানসারের উপাদান জর্দা ও পানমসলায়

জর্দা ও গুলের মতো বাংলাদেশের বাজারে সহজলভ্য ধোঁয়াহীন তামাকজাত পণ্য এবং পানমসলায় ক্যানসারের জন্য দায়ী ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে উচ্চমাত্রায় নিকোটিনও। বাংলাদেশসহ চার দেশের বাজারে থাকা তামাকজাত পণ্য ও পানমসলার নমুনা সংগ্রহ করে পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য জানা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির কলেজ অব ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সের একদল গবেষক গবেষণাটি করেছেন। বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী প্লস ওয়ান সম্প্রতি গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশ করেছে।

গবেষণার জন্য বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে মোট ৪৮টি তামাকজাত পণ্য এবং পানমসলার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের পণ্য রয়েছে ৩৪টি। এর মধ্যে ২২টি জর্দা, ৪ ব্র্যান্ডের গুল,৩টি পানমসলা ও ৩ ধরনের সুপারি রয়েছে। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে এসব পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। গবেষকেরা বলছেন, তামাকজাত পণ্যের নিকোটিন আসক্তি তৈরি করে। এ ছাড়া এসব পণ্যে নাইট্রোসেমিন (টিএসনএ) নামের একধরনের রাসায়নিক উপাদান থাকে, যা মুখের ক্যানসারের জন্য দায়ী।

গবেষকেরা ধোঁয়াহীন তামাকপণ্য (এসএলটি) বোঝাতে গুঁড়া তামাক, গাঁজন করা তামাক, জর্দা, গুল, সাদাপাতা, গোটা, খইনি, নস্যি ও পানমসলাকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা বলছেন, এসব পণ্যে ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি জনস্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে।

গবেষণার ফলাফলে জানা গেছে, বাংলাদেশের বাজারের জর্দা, গুল ও সাদাপাতার প্রতি ১ গ্রামে গড়ে ৪৬ মাইক্রোগ্রাম নাইট্রোসেমিন পাওয়া গেছে। অন্যদিকে এসব পণ্যের ক্ষেত্রে ভারতে ১৩ মাইক্রোগ্রাম, পাকিস্তানে শূন্য দশমিক ৮১ মাইক্রোগ্রাম এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৭ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম নাইট্রোসেমিন পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের বাজারে থাকা তামাকজাত পণ্যের নিকোটিনের পরীক্ষায় প্রতি ১ গ্রামে গড়ে ৩১ মাইক্রোগ্রাম নিকোটিন পাওয়া গেছে। সে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের পণ্যে ২৫ মাইক্রোগ্রাম, ভারতের ২০ মাইক্রোগ্রাম ও পাকিস্তানে ১০ মাইক্রোগ্রাম নিকোটিন পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশের বাজারে থাকা পানমসলার নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, গড়ে প্রতি ১ গ্রাম পানমসলায় ১ দশমিক ২ থেকে ১ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম ক্ষতিকর নাইট্রোসেমিন এবং গড়ে ২৫ মাইক্রোগ্রাম নিকোটিন রয়েছে। এ ছাড়া শুকনা, ভেজা ও মিষ্টি সুপারির নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ১ গ্রাম মিষ্টি সুপারিতে শূন্য দশমিক ৪৯ নাইট্রোসেমিন ও শূন্য দশমিক ৫৯ মাইক্রোগ্রাম নিকোটিন রয়েছে। তবে গবেষণায় শুকনা ও ভেজা সুপারিতে ক্ষতিকর নাইট্রোসেমিন ও নিকোটিন পাওয়া যায়নি।

এই গবেষক দলে ছিলেন ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির কলেজ অব ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সে পিএইচডি গবেষক শামীমা নাসরিন। বাংলাদেশি এই গবেষক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ধোঁয়াহীন তামাকপণ্য ব্যবহারের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। এ ধরনের তামাকপণ্য সেবনের সঙ্গে ক্যানসারের কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না, তা জানতেই গবেষণাটি চালানো হয়। মানুষের শরীরে মুখগহ্বর ও গলবিলের ক্যানসার, ঠোঁট ও মুখের ক্যানসারের জন্য এসব ক্ষতিকর উপাদান অন্যতম দায়ী।

ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকর উপাদান ও নিকোটিনযুক্ত তামাকজাত যেকোনো পণ্য সেবনে মুখেরসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। অথচ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতা কম। আবার তামাকজাত পণ্য না হওয়া সত্ত্বেও পানমসলায় ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি উদ্বেগজনক। পানমসলা খেয়ে মানুষের নিকোটিনে আসক্তি ও ক্যানসারের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটালের এপিডেমিলজি বিভাগের প্রধান হাবিবুল্লাহ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, তামাকে চার হাজারের মতো রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। এর মধ্যে নাইট্রোসেমিন একটি। কোনো প্রাণীর শরীরে যে পরিমাণ নাইট্রোসেমিন ক্যানসার তৈরির জন্য দায়ী, তার চেয়ে বেশি পরিমাণে নাইট্রোসেমিন থাকে তামাক ও তামাকজাত পণ্যে। তাই ধূমপানের চেয়ে সরাসরি তামাক সেবনে ঝুঁকির মাত্রাও অনেক। মূত্রনালি ও জরায়ুর ক্যানসারেও পরোক্ষ ভূমিকা থাকে তামাকজাত পণ্যের। শ্বাসকষ্টের রোগ সিওপিডি ও হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় এসব পণ্য সেবনে।

ধোঁয়াহীন তামাকপণ্য ব্যবহারের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। এ ধরনের তামাকপণ্য সেবনের সঙ্গে ক্যানসারের কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না, তা জানতেই গবেষণাটি চালানো হয়।
শামীমা নাসরিন, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির কলেজ অব ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সে পিএইচডি গবেষক

নাম–ঠিকানাবিহীন তামাকপণ্য

গবেষণাটির জন্য বাংলাদেশ থেকে তিন ব্র্যান্ডের বহুল বিক্রীত পানমসলা পরীক্ষা করা হয়েছে। গত শনিবার ঢাকার নাজিরাবাজারে কয়েকটি পানের দোকান থেকে সাত ধরনের পানমসলার প্যাকেট সংগ্রহ করেন এই প্রতিবেদক। এর একটিতেও উৎপাদনকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা উল্লেখ ছিল না।

সামাজিক সংগঠন তামাকবিরোধী নারী জোটের (তাবিনাজ) আহ্বায়ক ফরিদা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে তাবিনাজের তামাক, জর্দা ও গুল নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম চলছে। এতে দেখা গেছে, বাজারে পাওয়া ৩৭১টি ব্র্যান্ডের অধিকাংশেরই সতর্কবাণী ও সুনির্দিষ্ট ঠিকানা উল্লেখ নেই। ঠিকানা না দেওয়ার উদ্দেশ্য, এদের যেন কেউ খুঁজে না পায়।