ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না সম্মুখযোদ্ধারা

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

করোনা মহামারির শুরুর দিকে ভয়ানক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি বাইরে চলাচলও সীমিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু জরুরি পরিস্থিতিতেও মানুষকে সেবা দেওয়ার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের তো আর ঘরে বসে থাকলে চলে না। ঝুঁকি নিয়েও তাঁরা দায়িত্ব পালন করে গেছেন, মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এখনো আছেন মানুষের পাশে। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসক-নার্সসহ চিকিৎসাকর্মীদের সেবা। আরও আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও প্রশাসনের কর্মকর্তা। সব উদ্যোগের সামনে থেকে মানুষকে সেবা দিয়েছেন তাঁরা। তাই করোনাবিরোধী লড়াইয়ে সম্মুখসারির যোদ্ধা বলা হচ্ছে তাঁদের।

করোনাবিরোধী লড়াইয়ে এই গুরুদায়িত্ব পালনের সময় কেউ আক্রান্ত হলে বা মারা গেলে তাঁদের জন্য প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন হাতে গোনা কয়েকজন।

ক্ষতিপূরণ ও প্রণোদনা পেতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনেক নথি পাঠাতে হয়। আমরা সার্বক্ষণিক কাজ করছি বিষয়টি সমাধানের জন্য।
জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী

সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর হিসাবমতে, এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ১৩৫ জন চিকিৎসক। মৃত্যু হয়েছে ১১৩ জনের। এর মধ্যে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন মাত্র ১ জন। করোনায় পুলিশ ও র‍্যাবে মৃত্যু হয়েছে ৮০ জনের, আক্রান্ত ১৮ হাজার ৫১৭ জন। ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ৩৮ জন।

এ ছাড়া প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের। আক্রান্ত হয়েছেন ৬৬৫ জন। এর মধ্যে ৪ জনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষতিপূরণ ও প্রণোদনা পেতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনেক নথি পাঠাতে হয়। আমরা সার্বক্ষণিক কাজ করছি বিষয়টি সমাধানের জন্য। কিছু চূড়ান্ত হয়েছে। কিছু কাজ চলছে। এ বিষয়ে আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই।’

কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীদের সেবায় সরাসরি কর্মরত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্য কর্মচারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে গত ২৩ এপ্রিল একটি পরিপত্র জারি করে অর্থ বিভাগ। সেটি অনুসরণ করেই প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। পরিপত্রে বলা হয়, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারি চাকরিজীবী যাঁরা নিজেরা আক্রান্ত হবেন বা মারা যাবেন, তাঁদের জন্য গ্রেড অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এর পরিমাণ ৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে ৫ লাখ টাকা ও মারা গেলে ২৫ লাখ টাকা, ১০ম থেকে ১৪তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও মারা গেলে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং প্রথম থেকে নবম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে ১০ লাখ টাকা এবং মারা গেলে ৫০ লাখ টাকা পাবেন।

অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ৪৪ জনকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এর মধ্যে চিকিৎসক মাত্র একজন। পুলিশ ও র‌্যাবের ৩৮ জন, প্রশাসনের চারজন এবং একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের সাবেক পরিচালক)।

দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হওয়া প্রথম চিকিৎসক সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দীন। মারা যাওয়া চিকিৎসকদের মধ্যে শুধু তাঁর পরিবারই এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পেয়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ এপ্রিল ক্ষতিপূরণের প্রথম আবেদন করেন চিকিৎসক মঈন উদ্দীনের স্ত্রী চিকিৎসক চৌধুরী রিফাত জাহান। এর ঠিক তিন মাস পর তিনি টাকা পান।

মৃত্যু হয়েছে ১১৩ চিকিৎসকের। ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন মাত্র ১ জন। র‌্যাব-পুলিশের মারা গেছেন ৮০ জন। ৩৮ জন পেয়েছেন ক্ষতিপূরণ। প্রশাসনের ১৮ কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে। ৪ জন পেয়েছেন ক্ষতিপূরণ।

অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, চিকিৎসকদের ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়ার পুরো দায়ভার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয় থেকে এখন পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পায়নি তারা। প্রস্তাব পেলেই তারা সঙ্গে সঙ্গে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে টাকা দেবে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের গাফিলতির জন্যই মারা যাওয়া চিকিৎসকদের পরিবার এখনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। সরকার ঘোষণা দিয়েই বলেছে, করোনা চিকিৎসা দিতে গিয়ে যাঁরা মারা গেছেন বা আক্রান্ত হচ্ছেন, সবাইকে প্রণোদনা দেবে। এখন মন্ত্রণালয়গুলোর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এ প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হচ্ছে।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা চিকিৎসা দিতে গিয়ে যাঁরা মারা গেছেন বা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের তালিকা অনেক আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। হয়তো যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে বিলম্ব হচ্ছে।’

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, করোনায় এ পর্যন্ত পুলিশ ও র‌্যাবের ৮০ জন সদস্য মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছে ১৮ হাজার ৫১৭ জন। এঁদের মধ্যে ৩৮ জন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখা থেকে জানানো হয়েছে প্রথম আলোকে। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হায়দার আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের হিসাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মৃত সদস্যদের মধ্যে ৯ জনের পরিবার ৫০ লাখ টাকা করে পেয়েছে। বাকি ২২ জনের বিষয়ে মন্ত্রণালয় ছাড়পত্র দিয়েছে।
করোনায় আক্রান্ত প্রশাসনের কর্মকর্তার সংখ্যা ৬৬৫। এর মধ্যে প্রশাসনের ১৮ জন কর্মকর্তা মারা গেলেও তাঁদের মধ্যে ৪ জন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন।

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্থানীয় সরকারসচিব হেলালুদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্মুখযোদ্ধারা যাতে দ্রুত ক্ষতিপূরণ ও প্রণোদনা পান, আমরা সেই চেষ্টা করছি।’