ক্ষতিপূরণ পেতে দুর্ভোগে প্রবাসে মৃতদের স্বজনেরা
বিভিন্ন দেশে দুর্ঘটনায় নিহত অন্তত ছয় হাজার ৬০ জন প্রবাসীর পরিবার তিন থেকে ২০ বছর ধরে ক্ষতি–পূরণের জন্য অপেক্ষা করছে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সর্বশেষ হিসাব থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
আর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাচ্ছে না।
সৌদি আরবে কর্মরত অবস্থায় ২০০১ সালের ২৭ এপ্রিল দুর্ঘটনায় মারা যান নির্মাণশ্রমিক ওমর ফারুক। তাঁর বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের বয়স তখন ১৪ বছর। নিয়মানুযায়ী বাবা যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, সেখান থেকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা পরিবারের। লক্ষ্মীপুর থেকে অনেকবার ঢাকায় এসে জান্নাত জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মাধ্যমে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। এই করতে করতেই পেরিয়ে গেছে প্রায় এক যুগ। অনেক চিঠি চালাচালি হয়েছে। জান্নাতের বিয়ে হয়েছে, তিনি সন্তানের মা হয়েছেন। কিন্তু বাবার মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণের টাকা এখনো পাননি।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সূত্রে জানা গেছে, ক্ষতিপূরণের এমন ছয় হাজার ৬০টি নথির মধ্যে তিন হাজার ৭৭৩টি ঢাকায় কল্যাণ বোর্ড ও জেলা জনশক্তি ব্যুরোর কার্যালয়ে আটকে আছে। আর দুই হাজার ৩৮৭টি নথি আটকে আছে ২২টি দূতাবাসে।
গত এক দশকে প্রবাসে ২৭ হাজার ৮৩৯ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ দুর্ঘটনায় মারা যান।
প্রবাসীদের কেউ দুর্ঘটনায় বা অস্বাভাবিকভাবে মারা গেলে তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম। ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতিপূরণ দিতে হয় চাকরিদাতাকেও। আর এ ধরনের ব্যক্তি বৈধ শ্রমিক হলে বাংলাদেশের দিক থেকে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড (২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে) তিন লাখ টাকা দেয়। আগে এ ধরনের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কোনো ক্ষতিপূরণ দিত না।
কিন্তু যথাসময়ে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে উদ্যোগ না নেওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষতিপূরণ পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে বলে অভিযোগ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের। কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, একটি ঘটনায় ১৮টি চিঠি দিয়েও সে দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনো উত্তর বা উদ্যোগ জানা যায়নি। ফলে এসব ঘটনার নিষ্পত্তি হচ্ছে না। পরিবারগুলো ভুগছে বছরের পর বছর।
তবে একাধিক দূতাবাস কর্মকর্তা এই ভোগান্তি জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও খোদ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে দায়ি করেছেন। তাঁদের দাবি, অনেকবারই এমন ঘটনা ঘটেছে যে বিদেশ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা ঢাকায় চলে গেছে, কিন্তু যথাসময়ে কল্যাণ বোর্ড ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ পায়নি।
কল্যাণ বোর্ডেও সূত্র জানায়, গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত কল্যাণ বোর্ডের হিসাবে ২৫ কোটি টাকা জমা পড়ে আছে। তারা সংশ্লিষ্ট স্বজনদের তা দিচ্ছে না।
জানতে চাইলে ওয়েজ আর্নার্স বোর্ডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিয়ুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি দুর্ঘটনা ঘটলে মামলা হয়। এই মামলা চালাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পরিবার থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (আমমোক্তারনামা) নিতে হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সত্যায়ন নিয়ে তা ওই দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠাতে হয়। এরপর দূতাবাস কাজ শুরু করতে পারে। এটি আসলে একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে অনেক বিভাগ জড়িত। প্রক্রিয়াগুলো শেষ করতেই দীর্ঘ সময় লেগে যায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর (রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট) সমন্বয়ক সি আর আবরার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দূতাবাস ও কল্যাণ বোর্ডের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে পরিবারগুলো যথাসময়ে ক্ষতিপূরণ পায় না।’ এ বিষয়ে কী করা উচিত, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে দেশে ঘটনা ঘটছে, সে দেশে যথাযথ নিয়ম মেনে কাগজপত্র জমা দিলে নির্ধারিত সময়েই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। কিন্তু তার পরও দেরি হওয়ার কারণ জানতে আমি অনেক শ্রম কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, অনেক সময়েই বাংলাদেশ থেকে ঠিকমতো কাগজপত্র পাঠানো হয় না। আবার প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, দূতাবাস থেকে নথি পাওয়া যায় না। আসলে দুই পক্ষের দায়িত্বহীনতার কারণেই এই ভোগান্তি। মন্ত্রণালয়ের উচিত দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা।’
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব খোন্দকার শওকত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকাপয়সা যেন ভুল লোকের কাছে না যায়, সে জন্য কাগজপত্র ঠিক করতে গিয়ে কিংবা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনেক সময়েই দেরি হয়ে যায়। আমরা এ সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করব।’
কোন দেশে কতজন: কল্যাণ বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, কিন্তু ক্ষতিপূরণ পাননি এমন প্রবাসীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে রিয়াদে দুই হাজার ৩৭৪ জন। জেদ্দায় এক হাজার ৩২ জনের স্বজনেরা এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি।
এর পরের দেশটি আরব আমিরাত। এর মধ্যে আবুধাবিতে নিহত ৭৭১ জন এবং দুবাইতে নিহত ৩৯৮ জনের পরিবার এখনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। মালয়েশিয়ায় এমন মামলা আছে ৬০৭ জনের। এর মধ্যে ১৪৬টি নথি দূতাবাসে এবং ৪৬১টি জনশক্তি কার্যালয়ে আটকে আছে।
একইভাবে সিঙ্গাপুরে ২০৩ জন, কুয়েতে ১৮৯, বাহরাইনে ২০২, লিবিয়ায় ৯২, লেবাননে ৩১, ইতালিতে ২২, মিসরে ১১, ব্রুনাইয়ে ৯, গ্রিস ও জর্ডানে ৮, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৭, মালদ্বীপে ৬, মরিশাস, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ জন করে মৃত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণের মামলা পড়ে আছে।
জানতে চাইলে সৌদি আরবের রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব (শ্রম) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘কেউ যদি দুর্ঘটনায় মারা যান এবং সেই দুর্ঘটনার জন্য সৌদি আরবের কোনো নাগরিক দায়ী থাকেন, তাহলেই নিহত একজন ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রতি তিনটি ঘটনার ক্ষেত্রে একটি ঘটনায় হয়তো ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। আর যদি কেউ তাঁর কোম্পানিতে অস্বাভাবিকভাবে মারা যান, তাহলে অনেক সময় তিনি ওই কোম্পানি থেকে কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’ তিনি বলেন, ‘কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা দূতাবাসের বদলে অন্য কাউকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার থাকে না। তখন কল্যাণ বোর্ড থেকে আমাদের একের পর এক চিঠি দেওয়া হলেও আমাদের কাছে ক্ষমতা না থাকায় সৌদি কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনো তথ্য দেয় না।’
আবার সৌদি আরবের জেদ্দার বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর মোকাম্মেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিহত ব্যক্তির পরিবার যাদের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেয়, আমরা তাদের কোনো সহযোগিতা লাগলে দিই।’
কল্যাণ বোর্ডের অবহেলার একটি উদাহরণ ওমানে ২০১৩ সালের ২৭ জুন মারা যাওয়া আলম নূরের ঘটনাটি। ওমানের বাংলাদেশ দূতাবাস আইনগত প্রক্রিয়া শেষ করে ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রায় ২০ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেয় আলম নূরের পরিবারের জন্য। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের হিসাবে সেই টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু সাত মাসেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সেই টাকা পায়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওমানের একটি আদালতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পক্ষে মামলা হলে বিষয়টি নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। ওমান দূতাবাস থেকে তখন আবার মামলার কপিসহ চিঠি দেওয়া হয় ঢাকায়। এ ঘটনায় বাংলাদেশ নিয়েই নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।
তবে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিয়ুর রহমান বলেন, ‘আমরা এখন চেষ্টা করছি যেন পুরোনো ফাইলগুলোর নিষ্পত্তি হয়ে যায়।’