একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে নাক গলাতে পাকিস্তানকে নিষেধ করার পরও দেশটি বিবৃতি দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। গত শনিবার রাতে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসির পরপরই পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুঃখ প্রকাশ করে একটি বিবৃতি দেয়। এর প্রতিবাদে ঢাকায় দেশটির ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে গতকাল রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ স্পষ্ট করেই বলেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মতামত দেওয়ার সুযোগ পাকিস্তানের নেই। তাদের এ ধরনের মন্তব্য অগ্রহণযোগ্য। মানবতাবিরোধীদের পক্ষে বিবৃতি দেওয়ায় গণহত্যায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততাই প্রমাণ করে।
এদিকে পাকিস্তানের পাশাপাশি তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে আবার বিবৃতি দিয়েছে। গতকাল এক বিবৃতিতে দেশটি জানায়, মীর কাসেম আলীর ফাঁসি তাদের মর্মাহত করেছে। গত মে মাসে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের পর তুরস্ক এবারও বিচার নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাল। ওই সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নিজামীর ফাঁসি নিয়ে বিবৃতি দেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (দ্বিপক্ষীয় ও কনস্যুলার) কামরুল হাসান তাঁর দপ্তরে পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সামিনা মেহতাবকে ডেকে পাঠান। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক মনোয়ার হোসেন। এ সময় সামিনা মেহতাবের হাতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি কূটনৈতিক পত্র তুলে দিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির প্রতিবাদ জানানো হয়।
পাকিস্তানকে দেওয়া ওই কূটনৈতিক পত্রে বাংলাদেশ বলছে, বারবার মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় দোষী সাব্যস্ত বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষ নিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার মতো অপকর্মে পাকিস্তানের সরাসরি সম্পৃক্ততা আবারও প্রমাণ করেছে। এর মধ্য দিয়ে ৪৫ বছর আগের অপরাধের দায়মুক্তির সংস্কৃতি রোধ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশের প্রয়াসে অব্যাহত বিরোধিতা করছে পাকিস্তান।
ওই পত্রে, ‘রাজনৈতিক ফায়দা লোটার’ জন্য বিচার পরিচালিত হচ্ছে বলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ বাংলাদেশ নাকচ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের বক্তব্য হচ্ছে, মীর কাসেম আলীর বিচার হয়েছে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী ও গণহত্যার সুনির্দিষ্ট অপরাধের দায়ে, তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে হত্যা, গণহত্যা ও নির্যাতনে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে যুক্ত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক রীতি ও মানদণ্ড মেনে ১৯৭১ সালের গণহত্যার দায়ে চিহ্নিত পাকিস্তানের ১৯৫ জন নাগরিককে বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাধ্যবাধকতা পূরণে পাকিস্তানের ব্যর্থতার বিষয়টি ঢাকায় দেশটির ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৪ সালের চুক্তিটি পাকিস্তানের ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ফিরিয়ে নেওয়া এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যে সীমিত। পাকিস্তানকে দেওয়া কূটনৈতিক পত্রে কঠোরভাবে বলা হয়েছে, রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের ১৯৭৪ সালের চুক্তিতে কোনোভাবে দায়মুক্তি দেওয়া হয়নি। এমনকি ১৯৭৪ সালের চুক্তির পর এবং ১৯৭৫ সালের শেষে বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে এ দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছিল এবং ওই বিচার নিয়ে পাকিস্তান কখনো ১৯৭৪ সালের চুক্তির প্রসঙ্গ টেনে উদ্বেগ জানায়নি। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যার পর ওই সব অপরাধীদের মুক্তি দেওয়া হয়। বারবার ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা এবং এর অপব্যাখ্যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের অব্যাহত আহ্বানের পরও মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তানের বিদ্বেষপূর্ণ অপপ্রচার অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং এটি দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশের এই অবস্থানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরতে বলা হয়েছে। পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল আচরণ করবে এবং অব্যাহতভাবে এ ধরনের অপ্রত্যাশিত বিবৃতি দেওয়া থেকে বিরত থাকবে বলে আশা করে বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলবের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন কামরুল হাসান। তিনি বলেন, মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড নিয়ে পাকিস্তান যে মতামত দিয়েছে, সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। এ বিচার স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হয়েছে। তাঁর আপিল করার সুযোগ ছিল। আপিলের সুযোগ তিনি নিয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালত মনে করেছেন, তিনি ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী যে অপরাধ করেছেন, এটাই তাঁর উপযুক্ত শাস্তি। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কাজেই এ নিয়ে পাকিস্তানের মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই।
পাকিস্তানের বিবৃতি: গত শনিবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের আগে সংঘটিত ‘কথিত’ অপরাধের অভিযোগে ‘ত্রুটিপূর্ণ বিচার’ প্রক্রিয়ায় মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় পাকিস্তান গভীরভাবে মর্মাহত। ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বিচারের মাধ্যমে বিরোধীদের দমন গণতান্ত্রিক চেতনার পুরোপুরি পরিপন্থী। ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অংশ হিসেবে ক্ষমাশীলতার পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে না নিতে রাজি হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে সেই অঙ্গীকার সমুন্নত রাখা উচিত।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। ওই রায় কার্যকরের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তখনকার মুখপাত্র মন্তব্য করেন, কারও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা পাকিস্তানের নীতি নয়। এরপরও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের বিষয়টির প্রতি পাকিস্তান নজর রাখছে। এরপর ২০১৫ সালের এপ্রিলে জামায়াতের নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের পর বিবৃতি দেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র। ওই বছরের নভেম্বরে বিএনপির নেতা সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় এবং ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অপব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এ বছর জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি নিয়ে একাধিকবার বিবৃতি দেয় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।