‘খাওয়ুনের দরকার নাই, বান্দের স্থায়ী ব্যবস্থা করুইন’

টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গত মঙ্গলবার রাতে ভোগাই নদের উত্তর গড়কান্দা এলাকায় শহর রক্ষা ১০০ মিটার বাঁধ ভেঙে যায়। উত্তর গড়কান্দা, নালিতাবাড়ী, শেরপুর, ২ জুলাই
ছবি: প্রথম আলো

চাতালশ্রমিক খোদেজা বেগমের (৫৫) বসতবাড়ির ৩৫ শতক জায়গা ছিল। কয়েক বছর ধরে পাহাড়ি ঢলের কারণে ভোগাই নদের ভাঙন হচ্ছে। সে ঢলে ভিটেবাড়ির বেশির ভাগ অংশ নদে বিলীন হয়ে গেছে। এখন বাড়ি–ভিটা বলতে শুধু থাকার একটি মাটির ঘর।

গত মঙ্গলবার আবার ভাঙন হলে ঘরের জিনিসপত্র দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নেন। তখন স্বামী-স্ত্রী আশ্রয় নেন রাস্তায়। কোনোমতে শুধু থাকার ঘরটি টিকে রয়েছে। ঢলের পানিতে তা–ও হুমকির মুখে।

খোদেজা শেরপুরের নালিতাবাড়ী পৌর শহরের উত্তর গড়কান্দা গ্রামের দিনমজুর ফজল আলীর স্ত্রী। প্রায় ৩০ বছর আগে তাঁরা অল্পমূল্যে নদের পাড়ে ৩৫ শতক বাড়ি-ভিটা কেনেন। স্বামী খাদ্যগুদামে ও স্ত্রী চাতালে শ্রমিকের কাজ করে যা পান তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। তাঁদের দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে স্ত্রী নিয়ে আলাদা থাকেন।

আজ শুক্রবার সকালে নদের ভাঙন অংশ দেখিয়ে খোদেজা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হুনছিলাম গাঙের পাড়ে পাকা বান্দ দিবো। মনে মনে মসজিদে একটা ফ্যান মানত করছিলাম। কিন্তু বান্দের কোন খবর নাই। প্রতিবছর বান্দ ভাঙতাছে। অহন শুধু আমার ঘরডা বাহি (বাকি) আছে। অনেকেই খাওয়ন দিচ্ছে। খাওয়ন দিয়া কি অইবো। খাওয়ুনের দরকার নাই, বান্দের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করুইন তাইলেই অইবো।’

শুধু খোদেজা একা নন। তাঁর মতো অনেক পরিবার কয়েক বছর ধরে নদের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁরা নদের বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন।

উপজেলা প্রশাসন ও ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার রাতে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভোগাই নদের শহরের উত্তর গড়কান্দা এলাকায় শহর রক্ষা ১০০ মিটার বাঁধ ভেঙে যায়। এ ছাড়া উপজেলায় আরও চারটি স্থানে প্রায় দুই কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে যায়।

উত্তর গড়কান্দা এলাকায় ভাঙন অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে এই এলাকার প্রায় এক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। বাড়িঘরে পানি থাকায় নিরুপায় হয়ে ১৫-২০টি পরিবার পাশে বাগানবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গরু–ছাগল ও হাস–মুরগি নিয়ে আশ্রয় নেয়।

গত বুধবার রাতে ভোগাই নদের পানি কমে যাওয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বাড়িঘর থেকে পানি নামতে শুরু করে। ঢলের পানির সঙ্গে পলিমাটি থাকায় এতে অর্ধশতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্তের শিকার হয়। এলাকাবাসী উত্তর গড়কান্দা এলাকায় ৫০০ মিটার এলাকা নিয়ে পাকা বাঁধের দাবি জানান।

গতকাল বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোমিনুর রশীদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হেলেনা পারভীন এই ভাঙন অংশ পরিদর্শন করেছেন।

উত্তর গড়কান্দার দিনমজুর তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই বান্দের লাইগা প্রতিবছর মানুষ চরম কষ্ট করে। এইন একটা পাকা বান্দের ব্যবস্থা করা অইলে এলাকার মানুষের বিরাট উপকার অয়।’

ওই গ্রামের বাসিন্দা খোরশেদ আলম বলেন, ‘প্রতিবছর এখানে বাঁধ ভেঙে গিয়ে বাড়িঘরে কোমর পর্যন্ত পানিতে সবকিছু ডুবে যায়। তখন মানুষ নিরুপায় হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তা বা অন্যত্র অবস্থান করে। এ সময় ঢলের পানিতে মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। এখানে একটা ব্লগ দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করে দিতে সরকারে কাছে দাবি জানাই।’
এ ব্যাপারে ইউএনও হেলেনা পারভীন বলেন, ইতিমধ্যে ভাঙন অংশ ডিসি স্যার পরিদর্শন করেছেন। ভাঙন অংশে ব্লকের মাধ্যমে স্থায়ী বাঁধের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিসি মোমিনুর রশীদ বলেন, ‘ভাঙন অংশ এলাকা পরিদর্শন করেছি। ভোগাই নদের ভাঙন অংশ সংস্কারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’