খালি মাঠ পেয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিস্তার ঘটছে: পঙ্কজ ভট্টাচার্য

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, রমনা, ৭ জানুয়ারি
ছবি: দীপু মালাকার

প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেছেন, দেশে খালি মাঠ পেয়ে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটছে। সক্রিয় বিরোধী দল নেই, কার্যকর সংসদ নেই, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানেরও অভাব। তাই খালি মাঠ পেয়ে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী শক্তি সঞ্চয় করছে, আর তাদের বিস্তার ঘটছে।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের দশম ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের প্রথম দিনের শেষ অধিবেশনে এসব কথা বলেন বক্তারা। আজ শুক্রবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এ সম্মেলন শুরু হয়। দিনব্যাপী আয়োজনের শুরুতে সকালে সম্মেলনের উদ্বোধন হয়। ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে নাচ–গান, প্রদীপ প্রজ্বালন, কবুতর ও বেলুন ওড়ানোর মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। এরপর জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা ও ঐক্য পরিষদের পতাকা উত্তোলন করা হয়।

বিকেলের অধিবেশনে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারপারসন পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘আজ মানবতা ও মানবাধিকারের বড় দুর্দিন। সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি মানুষ অশান্তিতে। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রকে বলতে চাই, তুমি কার?’
গেল বছর দুর্গাপূজার সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনা নিয়ে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, প্রধান উৎসব আক্রান্ত হয়েছে, এ কথা ব্রিটিশ আমলে শোনেননি, পাকিস্তান আমলে দেখেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবার এবার দেখলেন। এর পেছনে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী আছে। এ দুয়ের উত্থান রোধে চাই মুক্তিযুদ্ধের পুনর্নির্মাণ।

অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, লুটেরা অর্থনীতি আর বিপর্যস্ত রাজনীতিকে উদ্ধার করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শকে সামনে আনতে হবে। এখন ভিশন ১৯৭১ নিয়ে এগোতে হবে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বলা হচ্ছে ধনীরা ধনী হতে থাকুক। তাতে তাদের সম্পদ থেকে চুয়ে পড়া সম্পদ পাবেন অপেক্ষাকৃত দরিদ্ররা। বাস্তবে কিন্তু তা হয় না। ধনীদের সম্পদ চুয়ে পড়ে না, এসব এখন কানাডা কিংবা আমেরিকায় চলে যায়।

অনুষ্ঠানে ভার্চু৵য়ালি যুক্ত হয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, সামরিক সরকারগুলো দেশের সংবিধানকে কলুষিত করেছে। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা লুপ্ত হয়েছে, রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরেপেক্ষতা যুক্ত হলেও সংবিধানের মূল চেতনা ফিরে আসেনি।

অনুষ্ঠানে ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, ধর্মীয়–জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষা আজকের বাংলাদেশে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন সময়ের দাবি। এগুলো বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও ছিল। এর পাশাপাশি ১৯৭২–এর সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়।

সংখ্যালঘু কমিশন ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য পৃথক কমিশন গঠনের দাবিকে সমর্থন করেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, পূজার সময় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা সরকারের বড় লজ্জার বিষয়। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

পূজার সময় হামলা প্রসঙ্গে অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ক্ষমতায়ন হলেই যে পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে তা বলা যায় না। এতজন সংখ্যালঘু সাংসদ আছেন, তাঁদের মধ্যে কজন এই হামলা নিয়ে সংসদে কথা বলেছেন? কে বা কারা জড়িত সেসব জানতে চেয়েছেন?

দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলেন, ‘আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছি। কিন্তু নাগরিকের অধিকারকে বিবেচনায় আনছি না। নাগরিকের পূর্ণ অধিকার বাস্তবায়ন না হলে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন পূর্ণ হবে না। আয়ের সঙ্গে সঙ্গে অধিকারের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।’

আয়ের সঙ্গে সঙ্গে অধিকারের বিষয় যুক্ত করে বর্তমান সরকারের অর্জনকে খাটো করার প্রয়াস চালানো হয়েছে বলে অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। তিনি আজ এ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন।

সাংসদ আরমা দত্ত অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, ‘আমরা সংসদে কথা বলেছি বা কিছু করেছি কি না, সেই কোষ্ঠী কাউকে দিতে যাব না। দুর্গাপূজার ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী সক্রিয় ছিলেন এসব হামলা রোধে।’

আজকের আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি উষাতন তালুকদার। আরও বক্তব্য দেন সভাপতি নিম চন্দ্র ভৌমিক, নির্মল রোজারিও, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী সিকদার, সাংসদ শামীম হায়দার পাটোয়ারী প্রমুখ।