খিলগাঁও উড়ালসড়কেও যানজট

প্রায় দুই কিলোমিটারের খিলগাঁও উড়ালসড়কের এপার-ওপার প্রায় অর্ধেকটা জুড়েই যানবাহন। থেমে আছে তো থেমেই আছে। এই উড়ালসড়কে সকালে অফিস যেতে এবং বিকেলে ফিরতি পথে যানজটে আটকে থাকা এখন প্রায় নিত্যদিনের নিয়তি। নিচের দুই পাশের সড়কেও রিকশা-অটোরিকশা আর লেগুনার দীর্ঘ জট। নিচের এই জটলা আবার থাকে দিনের অন্য সময়েও।
পথচারী থেকে গাড়ির যাত্রী—সবারই ভোগান্তিস্থল এখন এই উড়ালসড়কের ওপর আর নিচ। বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা। নিচে তো বটেই। পানি জমে যায় উড়াল সড়কের ওপরেও। ভাঙাচোরা সড়কেও রিকশার জট যাত্রী ও পথচারীর জন্য বাড়তি দুর্ভোগ বয়ে আনে। গতকাল বুধবার সকাল এবং বিকেলে এলাকায় ঘুরে দুই ধরনের ভোগান্তিই দেখা যায়।
সকাল পৌনে ১০টার দিকে উড়ালসড়কের উত্তর শাহাজাহানপুর প্রান্তে জটে আটকে থাকা গাড়ি থেকে নেমেই বিষোদ্গার করলেন ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফুর রহমান—‘যানজট দূর করার জন্য ঢাকা শহরে ফ্লাইওভার তৈরি হয়, অথচ ব্যবহার করতে গিয়ে বেশির ভাগ দিনই সেই যানজটেই পড়তে হয়। কী লাভ এত টাকা খরচ করে ফ্লাইওভার বানিয়ে।’
গাড়ি থেকে নেমে আরিফুর রহমানের মন্তব্যে সায় দিলেন যানজটে ফেঁসে যাওয়া অন্যেরাও। দেখা গেল, উড়ালসড়কের উত্তর শাহাজাহানপুর প্রান্ত থেকে খিলগাঁও ছাড়িয়ে বাসাবো পর্যন্ত যত দূর দৃষ্টি যায়—শুধু যান আর যান। সচিবালয়ে যাবেন আফসার আহমেদ। বললেন, ‘জরুরি কাজ আছে ভূমি মন্ত্রণালয়ে। যেতে হবে সকাল ১১টার মধ্যেই। যেতে পারব কি না খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে!’
নিচেও স্থবির যানবাহনের সারি। বিশেষ করে রিকশার জট। উড়ালসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে পূর্ব-পশ্চিম দেখে এজিবি কলোনির বাসিন্দা জাহিদুল হক মন্তব্য করলেন, ‘ঢাকার সব রিকশা মনে হয় এখানেই জট বেঁধেছে।’ পূর্ব দিকে সুখী ফার্নিচারের সামনের সড়কে রিকশা আর লেগুনার জট। পশ্চিম প্রান্তে ইউনুস ফার্নিচারের সামনে ওই একই চিত্র। একদিকে শাহাজাহানপুর চৌরাস্তা ছাড়িয়ে রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ি পানির পাম্প পর্যন্ত, অন্যদিকে খিলগাঁও রেলগেট পর্যন্ত সড়কে যানবাহনের জট।
বুধবার দুপুরে নেমেছিল এক পশলা মাঝারি বৃষ্টি। তাতেই উড়ালসড়কের দুই পাশের সড়কে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত পানি জমে যায়। উড়ালসড়কের গোড়া থেকে প্রায় এক শ মিটার দূরুত্ব পর্যন্ত জমে যায় পানি। স্থানীয় ওরিয়েন্টাল ডেন্টালের কর্মচারী আবুল হাশেম বলেন, ‘বৃষ্টি হলে যানজট আরও বেড়ে যায়। উড়ালসড়কেও পানি জমে যায়। এতে ভোগান্তি আরও বাড়ে।’
বিকেল সোয়া চারটার দিকে মতিঝিল থেকে খিলক্ষেত প্রভাতিবাগ যাচ্ছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আফরোজা বানু। পশ্চিম প্রান্তে ইউনুস ফার্নিচারের কাছে রিকশায় বসেছিলেন তিনি। সামনে এগোনোর উপায় নেই, তবু রিকশাওয়ালাকে বলেন, ‘তাড়াতাড়ি যাও ভাই, বাসায় গিয়ে ইফতার বানাতে হবে।’ প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সকালে আসতে মালিবাগ প্রান্তে প্রায় দেড় ঘণ্টা যানজটে ছিলাম। এখন কতক্ষণ লাগে ওপরওয়ালাই জানেন!’
একদিকে খিলগাঁও, শাহাজাহানপুর, বাসাবো, মুগদাপাড়া থেকে সায়েদাবাদ অন্যদিকে মালিবাগ বাজার পর্যন্ত ভয়াবহ যানজট দূর করতে খিলগাঁও উড়ালসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা হয় আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) মেয়াদে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর ২০০১ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়। ক্ষমতায় এসে বিএনপি সরকার প্রথমে এর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। মূল নকশা থেকে মতিঝিলে যাওয়ার একটি লুপ বাদ দেওয়া হয়। রাজনৈতিক ও বিভিন্ন কারণে ১৩ দফায় বড় ধরনের এবং শতাধিকবার ছোট ধরনের নকশা পরিবর্তন করে দুই বছরের জায়গায় প্রায় চার বছরে এই ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ শেষ হয়। ৫০ কোটির জায়গায় ৮২ কোটি টাকা খরচ করে ২০০৫ সালের ২৩ মার্চ খিলগাঁও উড়ালসড়ক চালু হয়। তখনই ঠিক করা হয় উড়ালসড়ক দিয়ে কোনো রিকশা বা অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করতে পারবে না। গতকাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নতুন করে দুটি লুপ তৈরি হচ্ছে।
শাহাজাহানপুর ছাড়াও পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা বাসাবো, কদমতলা, মায়াকানন, কদমতলা, আহম্মদবাগসহ আশপাশের কয়েক লাখ অধিবাসীর আশা ছিল এই উড়ালসড়কে তাঁরা উপকৃত হবেন। কিন্তু গতকাল ভুক্তভোগীরা বলেন, প্রতিদিন যানবাহন ও হাজারো রিকশার জট এলাকাবাসীর স্বস্তি বিনাশ করছে। তাঁরা জানান, রিকশা ও অযান্ত্রিক যানকে উড়ালসড়ক ব্যবহারের বাইরে রাখায় নিচে যানজট বেশি হচ্ছে। তার ওপর নিচের রাস্তাঘাট অনেক বছর ধরে বিধ্বস্ত হয়ে আছে।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হামিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, উড়ালসড়কের ওপরে ও নিচে যানজট কমানোর জন্য এলাকাবাসী এবং বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শ নিচ্ছেন। বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট মেরামতের জন্যেও সিটি করপোরেশনকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।