গণজাগরণ মঞ্চ, পাঁচ বছর পর কোথায়?

>• ইমরান বলছেন, সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে গণজাগরণ মঞ্চ।
• কেউ কেউ বলছেন, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন একাত্তরের পরে সবচেয়ে বড় অর্জন।
• ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান বলেন, এখন আর মঞ্চের দরকার নেই। ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থ উদ্ধারে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

পাঁচ বছর পূর্তি হলো গণজাগরণ মঞ্চের। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ব্লগারস অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বানে আর সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে শাহবাগে এ আন্দোলন শুরু হয়। পাঁচ বছর পূর্তিতে চলছে এ আন্দোলনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব। আন্দোলনের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের চোখে প্রাপ্তিই বেশি। তাঁর দাবি বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনে গণজাগরণ মঞ্চ ভূমিকা রাখছে।

ইমরান এইচ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণজাগরণ মঞ্চের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে সারা দেশে প্রতিবাদী মানুষ তৈরি করা। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ হওয়ার পর থেকে কোথাও কোনো অন্যায় হলে শাহবাগের আদলে সাধারণ মানুষ এর প্রতিবাদ করছে। একতাবদ্ধ হয়ে মাঠে নামছে।’ ইমরান বলেন, গণজাগরণ মঞ্চ গঠিত হওয়ার আগে জাতীয় আন্দোলনগুলো কেবল রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের কারণে এখন তা মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ এখন নিজেরাই আন্দোলনে নেমে পড়েছে।’

যে লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন, তার কতকগুলো পূরণ হয়েছে। শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই নয়, সামাজিক আন্দোলনেও গণজাগরণ মঞ্চের গুরুত্ব দেখছেন আন্দোলনের মুখপাত্র, ‘আমরা যেসব দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছিলাম, তার অনেক দাবি পূরণ হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আইন সংশোধন ও জামায়াত নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।’

গণজাগরণ মঞ্চকে একাত্তরের পরে সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করেন মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী। প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণজাগরণ মঞ্চের এই আন্দোলনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের গতি ত্বরান্বিত হয়েছে।’

আন্দোলনের গতি এখন আগের মতো নেই কেন, জানতে চাইলে লিটন নন্দী বলেন, ‘একটি আন্দোলন সব সময় সমান গতিতে চলে না।’ সময়ের প্রয়োজনে আবার আন্দোলনে গতি আসবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘এখনো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি, শোষণহীন সমাজ গড়ে ওঠেনি। গণজাগরণ মঞ্চ সামনের দিনে এগুলো নিয়ে রাজপথে সক্রিয় থাকবে।’

গণমানুষের এ আন্দোলনের কৃতিত্ব নিতে চাইছেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ। তাঁর দাবি, ছাত্রলীগই এ মঞ্চ তৈরি করেছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্যই মঞ্চ হয়েছিল। সে উদ্দেশ্য পূরণ করায় আর এ মঞ্চের প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না সোহাগ, ‘অধিকাংশ যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। এ মঞ্চের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। তাই এখন আর মঞ্চের দরকার নেই।’ তাঁর অভিযোগ, এ মঞ্চ এখন ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থ উদ্ধারের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। 

ছাত্রলীগ সভাপতির দাবিকে অগ্রাহ্য করেন ইমরান এইচ সরকার। তিনি বলেন, বরং এ মঞ্চের শুরু থেকে ছাত্রলীগ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মঞ্চ নির্মাণে ছাত্রলীগের দাবি অগ্রহণযোগ্য। ইমরান বলেন, মঞ্চের ছয় দফা দাবি ছিল। এর মধ্যে প্রথমটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। শুধু এটিই বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে দেশের সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার, তাদের সংগঠন এবং বিষয়সম্পত্তি নিষিদ্ধের দাবি বাস্তবায়িত হয়নি।

ব্যক্তিস্বার্থে মঞ্চকে ব্যবহারের দাবিকে অগ্রাহ্য করে ইমরান বলেন, ‘এখানে নিজেদের গাড়ি-বাড়ি, টাকাপয়সার জন্য আমরা কেউ কাজ করছি না। প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছি জনমানুষের দাবির জন্য।’ 

গণজাগরণ মঞ্চ তৈরির সময় বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে যে ঐক্য ছিল, তা আজ অনেকটাই নেই। মঞ্চের মধ্যেও বিভাজন ঘটেছে। তবে এত কিছুর পরও এ মঞ্চের প্রয়োজন রয়ে গেছে বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণজাগরণ মঞ্চ হয়তো আগের মতো নেই, কিন্তু যে চেতনা নিয়ে এটি শুরু হয়েছিল, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। মঞ্চের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঢাকায় বড় বড় সমাবেশ না করে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া। তাহলে তাদের অর্জন ছড়িয়ে পড়বে।’

গণজাগরণ দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি ছিল: বেলা দুইটা থেকে তিনটা চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ‘রঙ তুলিতে স্বপ্নের বাংলাদেশ’, বেলা তিনটায় গণজাগরণ দিবসের র‍্যালি ‘জাগরণ যাত্রা’, বেলা সাড়ে তিনটা ‘মতপ্রকাশে বাধা, সাম্প্রতিক কালা কানুন; কোন পথে বাংলাদেশ?’ শীর্ষক আলোচনা সভা, সন্ধ্যা ছয়টায় স্মৃতিচারণা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।