গণমাধ্যমের ওপর চাপ গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত: টিআইবি

বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের পরিসর ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে বলে উল্লেখ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, নানা কৌশলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিসরকে সংকুচিত করে রাখা হয়েছে। এর ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চর্চা কঠিন হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমের ওপর চাপ গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক ২০২০ অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম।

আজ সোমবার ‘তথ্য অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় এসব বিষয় তুলে ধরেছে টিআইবি। সভায় ‘দুর্নীতিবিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২০’ ঘোষণা করা হয়।

সভায় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানানো গেলেও এই আইনের বাস্তবায়নে সরকারের একাংশের মানসিকতা হলো ‘তথ্য হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি’। এর নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতেই থাকবে এবং সরকার যেভাবে যতটুকু তথ্য প্রকাশ করতে চাইবে, ততটুকুই প্রকাশিত হবে। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাবানদের একাংশের সমালোচনা সইবার সৎ সাহসের ঘাটতি থাকায় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উভয় বিবেচনায় তথ্য প্রকাশ করা একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় তথ্য প্রকাশের ওপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ একধরনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এ ছাড়া নানা আইনি বাধাও রয়েছে।

তথ্য অধিকার ও মতপ্রকাশের পরিস্থিতি নিয়ে সভায় একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ। প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশে সংখ্যার বিচারে গণমাধ্যমের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো হলেও স্বাধীনতার প্রশ্নে তা নয়। গণমাধ্যমে একধরনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ এখন কোনো রাখঢাক না রেখেই আরোপ করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাব এখন স্পষ্ট। আইনের শাসনের অবনতি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অবনতি একই সূত্রে বাঁধা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের জন্য প্রায় ৫০টি আইন ও নীতিমালা রয়েছে উল্লেখ করে প্রবন্ধে বলা হয়, এসব মূলত নিয়ন্ত্রণমূলক। এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অন্যতম। এ আইনের বেশ কিছু ধারা স্বাধীন মতপ্রকাশ, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও গবেষণার কাজে তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। আইনগত বাধার পাশাপাশি বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব এবং সৎ সাহসের অভাব।

মতপ্রকাশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গীতি আরা নাসরীন বলেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও তথ্যের জন্য যুদ্ধ করে যেতে হবে। গণমাধ্যম এখন ওয়াচডগের ভূমিকা কতটা পালন করতে পারছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সব মিডিয়া প্রায় একই ধরনের তথ্য প্রদান করছে, ভিন্ন তথ্য আসছে না।

করোনা পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতার প্রসঙ্গে টিআইবি বলেছে, করোনার সময়ে কোনো দেশই তথ্য প্রদানে সঠিক দায়িত্ব পালন করেনি। অনেক দেশের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশের বাধার অভিযোগ এসেছে। বাংলাদেশেও করোনা পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক তথ্যপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করার প্রবণতা দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে কথা বলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন নির্দেশনার কথাও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।

করোনার মধ্যে ৩৭ জন সাংবাদিকের নামে মামলা করা হয়েছে উল্লেখ করে টিআইবি বলেছে, ২০১৮ সালের শুরু থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ১৮০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে।

সভায় গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, এখনো বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে ‘উপরাজনৈতিক মাধ্যম’ ভাবা হয়, সংবাদমাধ্যম নয়। তিনি বলেন, মালিকপক্ষ সেভাবে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষিত করছে না।

সভায় আরও অংশ নেন টিআইবির উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা সুমাইয়া খায়ের, এমআরডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান, চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, এনটিভির বার্তাপ্রধান জহিরুল আলম, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রিজওয়ান-উল-আলম, সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক, শরিফুজ্জামান প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মঞ্জুর-ই-আলম।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় পুরস্কার

সভায় দুর্নীতিবিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ঘোষণা করে টিআইবি। এবার ছাপা কাগজের (প্রিন্ট ক্যাটাগরি) ক্ষেত্রে পুরস্কার পেয়েছেন কালের কণ্ঠ-এর সাংবাদিক আরিফুর রহমান, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এনটিভির সফিক শাহিন এবং প্রামাণ্যচিত্রে (টেলিভিশন) চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের ‘সার্চলাইট টিম’। স্থানীয় পর্যায়ে যৌথভাবে পুরস্কার পেয়েছেন যশোরের দৈনিক গ্রামের কাগজ-এর ফয়সাল ইসলাম এবং সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণীর মোহাম্মদ সেলিম। আঞ্চলিক ও জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ীদের প্রত্যেককে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার চেক প্রদান করা হবে। আর বিজয়ী প্রামাণ্য অনুষ্ঠানকে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার চেক প্রদান করা হবে।