গণিতের অলিম্পিকে বাংলাদেশ

২০০৫ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১টি স্বর্ণপদক, ৭টি রৌপ্য ও ৩১টি ব্রোঞ্জপদক এবং ৩৩টি সম্মানসূচক স্বীকৃতি পেয়েছে।

বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড এখন আর শুধু শিক্ষার্থীদের প্রিয় অনুষ্ঠান নয়, শিক্ষক এবং অভিভাবকেরাও তাঁদের উপস্থিতি দিয়ে গণিত উৎসবকে প্রাণবন্ত করে রেখেছেন
ছবি: প্রথম আলো

প্রাথমিক, মাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষা হোক, আমাদের পড়ালেখার মান যে নিম্নগামী, সে উপলব্ধি দেশের প্রায় সবার। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমাদের শিক্ষার মানের সম্মানজনক স্বীকৃতি নেই। এ ছাড়া স্কুল-কলেজের িশক্ষার্থীদের মধ্যে বিশেষ করে গণিত ও ইংরেজির প্রতি যে ভীতি, তা-ও আমাদের অজানা নয়। এসব বিষয়ে দেশের শিক্ষাসহ নানা বিষয় নিয়ে আন্তরিকভাবে ভাবেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তাঁর সঙ্গে নানা সময়ে আলোচনাও হয়েছে। একসময় আমরা ভাবলাম, গণিত অলিম্পিয়াড করা উচিত।

জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতি ভাইয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করি ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে। সারা দেশের শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে আমরা ভাবলাম, প্রতি সপ্তাহে কয়েকটি করে সমস্যা এতে ছাপানো যায়। এভাবে ছাপিয়ে দিলেই সবাই সমাধানের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে, এ রকম প্রত্যাশা আমরা করিনি। তাই তাঁকে অনুরোধ করলাম, যারা সমস্যাগুলো শুদ্ধভাবে সমাধান করবে, তাদের নামও যেন প্রথম আলোয় ছাপিয়ে দেওয়া হয়। সমস্যাগুলো ছাপা হতে লাগল নিউরনে অনুরণন নামে। এটা ছাপানো শুরু হয় ১৭ জুন ২০০১ সালে। আমরা অভাবনীয় সাড়া পেলাম। মহা উৎসাহী মুনির হাসান পড়লেন বিপদে! এত সমাধান যাচাই করার উপায় কী? যাচাইয়ের জন্য কিছু স্বেচ্ছাসেবী নেওয়া হলো। আমাদের মধ্যে সে কী উত্তেজনা! পরে জেনেছি, শুধু শিক্ষার্থীরা নয়; অনেক বয়স্ক, অভিভাবকেরাও তাঁদের বুদ্ধি ঝালাই করেছেন। পরে এসব সমস্যা নিয়ে নিউরনে অনুরণন এবং নিউরনে আবারও অনুরণন নামে দুটি বইও লিখেছিলাম আমরা।

একদিন আমাকে একজন ই-মেইল করে জানাল, সে সব কটি সমস্যা সমাধান করেছে। ই-মেইলে সেগুলো পাঠিয়েও দিয়েছে। আমি তো রীতিমতো অভিভূত। আরও অভিভূত হলাম জেনে যে সেই মানুষটি বুয়েটে ভর্তি হয়েছে, পাস করেছে, শিক্ষক হয়েছে, কিন্তু এত বছর ধরে সমস্যা সমাধানে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে ঠিকই। এ থেকে সম্ভবত তার পার্থিব কোনো উন্নতি হয়নি, তবে মেধার বিকাশ হয়েছে নিশ্চয়ই।

২০০২ সালের ২৬ জানুয়ারি কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনের মিলনায়তনে ছোট করে প্রথম গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন করা হয়। ডাচ্​-বাংলা ব্যাংক গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজনে অর্থায়ন করে। প্রথম আলোয় শুরু করে আয়োজন ও প্রচার। ২০০৪ সালে মুনির হাসান আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে পর্যবেক্ষক হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে; বাংলাদেশ সদস্যপদও লাভ করে। ২০০৫ সাল থেকে আমরা এই অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে আসছি।

প্রথম জাতীয় গণিত উৎসব আয়োজিত হয় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ও ১ ফেব্রুয়ারি। এর সাংগঠনিক কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক গৌরাঙ্গ দেব রায়। সদ্য প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার ছিলেন গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি। গণিত অলিম্পিয়াডের কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার জন্য এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বই প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের জন্য বয়সের বাধ্যবাধকতা নিচের দিক থেকে নেই, তবু সাধারণত নবম গ্রেড থেকে ছাত্ররা অংশ নেয়। চিন্তাভাবনা করে দেশে গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য চারটি গ্রুপ করা হলো। প্রাইমারি—তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি, জুনিয়র—ষষ্ঠ থেকে অষ্টম, সেকেন্ডারি—নবম-দশম এবং হায়ার সেকেন্ডারি—একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি। বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড এখন আর শুধু শিক্ষার্থীদের প্রিয় অনুষ্ঠান নয়, শিক্ষক এবং অভিভাবকেরাও তাঁদের উপস্থিতি দিয়ে গণিত উৎসবকে প্রাণবন্ত করে রেখেছেন। এই উৎসবের জনপ্রিয়তা দিন দিন আরও বাড়ছে।

২০০৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে গণিত অলিম্পিয়াডে আঞ্চলিক পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩১৯টি। এতে অংশ নিয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষার্থী। ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আঞ্চলিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে, ৬৭টি। এতে অংশ নিয়েছে প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী। গত দুবছর কোভিড-১৯–এর জন্য গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হচ্ছে অনলাইনে। এতে আঞ্চলিক পর্বে অংশ নিয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪ হাজার ৫০০ জন। সংখ্যাটা যে অনেক বেড়েছে, তা এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের দিকে যদি তাকাই, ২০০৫ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১টি স্বর্ণপদক, ৭টি রৌপ্য ও ৩১টি ব্রোঞ্জপদক এবং ৩৩টি সম্মানসূচক স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০০৯ সালে প্রথম ব্রোঞ্জপদক, ২০১২ সালে প্রথম রৌপ্যপদক এবং ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রথম স্বর্ণপদক আসে আমাদের দেশে। আমাদের সবচেয়ে ভালো র​্যাঙ্ক ২৬ (২০১৭ সালে), সেবার ভারতের র​্যাঙ্ক ছিল ৫২। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ভালো ফলের জন্য আমাদের অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগও পাচ্ছে। ২০০৭ সালে টোকিও ও ক্যালটেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। ২০০৯ সালে এমআইটি ও কেমব্রিজে এবং ২০১০ সালে ভর্তি হয়েছে হার্ভার্ডে।

গণিত অলিম্পিয়াডের সাড়া জাগানো সাফল্যের নেপথ্যে এবং সামনে রয়েছেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতো মহীরুহ। তাঁর জন্যই ভগ্ন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা নিশ্চিন্তে গণিত অলিম্পিয়াডের নানা কর্মকাণ্ড করতে পেরেছি। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের অতুলনীয় জনপ্রিয়তা আকৃষ্ট করেছে শিক্ষার্থী থেকে অভিভাবকদেরও। ড. মাহবুব মজুমদারের মতো দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত মানুষের প্রশিক্ষণের ফলে তুলনামূলকভাবে দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বের হয়ে এসেও আমাদের ছেলেমেয়েরা এতগুলো পদক পেয়েছে।

গণিত অলিম্পিয়াডের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখন আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড, ফিজিকস অলিম্পিয়াড, জ্যোতির্বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডেও অংশগ্রহণ করছে এবং পদক পাচ্ছে। অবশ্য একথা মনে রাখতে হবে, যে অলিম্পিয়াডগুলোতে আমাদের অর্জন দিয়ে স্কুল-কলেজের পড়ালেখার মান অনুমান করা যাবে না। আমাদের শিক্ষার মান বাড়াতে আরও তৎপর হতে হবে। যে দেশে জনঘনত্ব সব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, দেশের অনেক মানুষ দরিদ্র, এই বিশ্বায়নের পৃথিবীতে তাদের টিকে থাকতে হলে শিক্ষায় বিনিয়োগের বিকল্প নেই। বিকল্প নেই বিশ্বমানের শিক্ষার।

আশা করি, অলিম্পিয়াড ও প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মেধাবীরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে, আমরা আরও আত্মবিশ্বাসী হব, আরও দক্ষ হব, দেশের অর্থ বিশেষজ্ঞদের নামে পাচার করা হবে না, বড় বড় স্থাপনা তৈরি করবেন আমাদের দেশি বিশেষজ্ঞরা। জাতি হিসেবে আমরা আত্মবিশ্বাসী ও আত্মসম্মানবোধে বলীয়ান হব, এটাই আমার প্রত্যাশা।

একনজরে গণিত অলিম্পিয়াড

শুরু: ২০০২ সাল

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে

প্রথম অংশগ্রহণ: ২০০৫ সাল

প্রথম পদক: ২০০৯ সাল

সম্মানসূচক স্বীকৃতি: ২০০৬

প্রথম ব্রোঞ্জপদক: ২০০৯ সাল

প্রথম রৌপ্যপদক: ২০১২ সাল

প্রথম স্বর্ণপদক: ২০১৮ সাল

মোট স্বর্ণপদক: ১টি

মোট রৌপ্যপদক: ৭টি

প্রথম ব্রোঞ্জপদক: ৩১টি


মোহাম্মদ কায়কোবাদ: সদস্য বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি; অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়