গণিতের বৃহত্তম উৎসব
মেধাভিত্তিক কর্মকাণ্ডে উপমহাদেশে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব ঔপনিবেশিক আমল থেকেই প্রমাণিত। উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে অনেকেই জগৎজোড়া স্বীকৃতি পেয়েছেন, মুন্সিগঞ্জের জগদীশ চন্দ্র বসু, কালিয়াকৈরের মেঘনাদ সাহা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সত্যেন বোস তাঁদের অন্যতম। প্রকৌশলের ক্ষেত্রে ফরিদপুরের ড. এফ আর খান উচ্চ ইমারতের ডিজাইন করে জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন, তাও মাত্র ৫০ বছরের স্বল্পস্থায়ী জীবনে। সাহিত্যে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে গোটা এশিয়ায় প্রথম নোবেল পুরস্কার এসেছিল, যাঁর বিচরণক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশ, সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলের ছাত্র নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের দেহে–মনেও বাংলাদেশের মাটি, পানি, বায়ুর স্পর্শ রয়েছে, আর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তো বাংলাদেশেরই সন্তান।
স্বাধীনতা অর্জনের পরপর আমরা অলিম্পিক খেলাসহ নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলেও মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় আমাদের অংশগ্রহণ করা হয়নি। একবিংশ শতাব্দীতে যেকোনো দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদই মানুষ। এই সম্পদের উন্নয়ন করতে পারলেই আমাদের ঘনবসতিপূর্ণ দেশটি উন্নত দেশের কাতারে চলে আসতে পারে। আমাদের তরুণ–তরুণী, কিশোর–কিশোরীদের মেধাকে শাণিত করার জন্যই গণিত অলিম্পিয়াডের সূচনা হয়। ২০০১ সালের এপ্রিল মাসের কোনো একদিন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান প্রতি সপ্তাহে নিউরনে অনুরণন নামে পাঁচটি সমস্যা প্রথম আলোতে প্রকাশ করতে রাজি হন। তারপর আমরা দেখেছি শুধু স্কুল–কলেজের ছাত্ররাই নয়, বয়স্ক অনেক মানুষ তাদের সমাধান পাঠাতে থাকে, যার শুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য মুনির হাসানের গলদঘর্ম অবস্থা। আমরা সবাই এতে অনুপ্রাণিত হই। এই কার্যক্রমের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় আঞ্চলিক পর্যায়ে ২০০২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকায়, ১৫ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে এবং ১৯ এপ্রিল রাজবাড়ী জেলায় আঞ্চলিক গণিত অলিম্পিয়াডের আয়োজন করা হয়। প্রতিটি আঞ্চলিক অলিম্পিয়াডেই আশাতীত সাড়া পাওয়া যায়। দেশের বরেণ্য গণিতবিদদের অনেকেই এই অলিম্পিয়াডসমূহে যোগ দেন। আমরা গণিত অলিম্পিয়াড বলি না, বলি গণিত উৎসব, যাতে সব ছাত্রই আনন্দের সঙ্গে এখানে অংশগ্রহণ করে। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় এই যে এটা ইতিমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসবে পরিণত হয়েছে শুধু ছাত্রছাত্রীদের কাছেই নয়, অভিভাবক–শিক্ষক এবং শিক্ষানুরাগীদের কাছেও। তাই দেখা যায়, এই উৎসবগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা কমপক্ষে শিক্ষার্থীদের দ্বিগুণ।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় আমাদের অংশগ্রহণ শুরু হয় ২০০৪ সাল থেকে স্বাধীনতার ৩৩ বছর পর আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড দিয়ে। আমাদের তরুণ কিশোরেরা প্রমাণ করেছে চ্যালেঞ্জ যত কঠিনই হোক না কেন তার সামনে দাঁড় করালে তা তারা সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারে। শতাধিক দেশের এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের র্যাঙ্ক দেখলেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়। ২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের র্যাঙ্ক হলো ৮৫, ৮০, ৮০, ৭৫, ৫৮, ৬৯, ৭২, ৫৪, ৬১, ৫৩, ৩৩, ৩৫, ২৬। আমাদের স্থান যেখানে এবার ২৬ তখন ভারতের ৫২। ভারতীয় বংশোদ্ভূত অনেক গণিতবেত্তাই বড় বড় স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। যেমন মঞ্জুল ভার্গাভার ২০১৪ সালে ফিল্ডস মেডালপ্রাপ্তি কিংবা শ্রীনিবাস ভারাধনের ২০০৭ সালে আবেল পুরস্কার বিজয়, কিংবা মধুসূদন, সুভাষ খতের নেভানলিনা পুরস্কার বিজয়, রাজ রেড্ডির কম্পিউটার বিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারখ্যাত টুরিং পুরস্কার। সে তুলনায় আমাদের অর্জন উল্লেখ করার মতো নয়। কিন্তু গণিত অলিম্পিয়াডে আমাদের ছাত্ররা ভারতকে পেছনে ফেলেছে। অবশ্য জ্ঞানভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে নানা বিষয়েই আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারছি। যেমন ১৯৯৮ সাল থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করছে, সেখানে ভারতীয় ছাত্রদের বিপক্ষে তারা শ্রেয়তর দক্ষতা প্রমাণ করছে। কম্পিউটার খাত থেকে ভারত ১০০ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে, সে তুলনায় আমাদের কম্পিউটার শিল্পের অর্জন ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। অথচ আমাদের তরুণ কিশোরেরা কিন্তু উল্টো তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখছে এবং এই খাতে আমাদের সুপ্ত শক্তির প্রমাণ রাখছে। ১৯৯৯ সালে আইআইটি কানপুরে অনুষ্ঠিত প্রোগ্রামিংয়ের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় সব আইআইটির দলসমূহকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দল চ্যাম্পিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দল রানারআপ হয়েছিল। শুধু তা–ই নয়, ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অরল্যান্ডো শহরে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় এমআইটি, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, বার্কলেসহ বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পেছনে ফেলে একাদশ স্থান দখল করেছিল। আমাদের স্কুল–কলেজের ছাত্ররাও কিন্তু কম্পিউটার দক্ষতায় পিছিয়ে নেই। সব অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতার মধ্যে প্রথম যে রৌপ্যপদক আসে তা আমাদের ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র মোহাম্মদ আবীরুল ইসলামের হাত ধরে বুলগেরিয়ার প্লভদিভ শহরে ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড থেকে, যেখানে উপমহাদেশের ৮ প্রতিযোগীর মধ্যে আবীরের অবস্থান ছিল সবচেয়ে ওপরে। তারপর বৃষ্টি সিকদার ২০১২ সালে ইতালিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড থেকে মেয়েদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়ে পুরস্কৃত হয়। এবারও ইরানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড থেকে বাংলাদেশের তিনজন স্কুল ও একজন কলেজের ছাত্র চারটি ব্রোঞ্জপদক পেয়েছে। ভারতীয়রা এই আসর থেকে পেয়েছে তিনটি ব্রোঞ্জ। শুধু তা–ই নয়, এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো দলের সব সদস্য পদক অর্জন করেন। এবার আন্তর্জাতিক পদার্থবিজ্ঞানের অলিম্পিয়াড থেকে আমাদের দল একটি রৌপ্য ও তিনটি ব্রোঞ্জপদক পেয়েছে। আগামী দিনগুলো যে আরও উজ্জ্বল হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
এসব পরিসংখ্যানই বলে মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের তরুণ কিশোরদের শ্রেষ্ঠত্ব শুধু তাই নয়, এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আমাদের অনেক ছাত্র এমআইটি, হার্ভার্ড, ক্যামব্রিজসহ নানা বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিরও সুযোগ পাচ্ছে। যারা প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা করে, গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে তাদের অনেকেই অতি অল্প বয়সে মাইক্রোসফট, গুগল, ফেসবুক, টুইটারসহ বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানসমূহে অতি উচ্চ বেতনে মর্যাদার চাকরি করছে। এই প্রতিযোগিতায় সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বসভায় একটি শ্রেয়তর ভাবমূর্তি গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের তরুণ সমাজের।
এ ছাড়া রয়েছে মানসাঙ্কের বিশ্বকাপ (মেন্টাল ক্যালকুলেশন ওয়ার্ল্ড কাপ)। প্রতি দুই বছর অন্তর জার্মানিতে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, যাতে ১০ অঙ্কের ১০টি সংখ্যা ১০ বার যোগ করতে কত সময় লাগে, দুটি ৮ অঙ্কের সংখ্যা ১০ বারে গুণ করতে কত সময় লাগে, ১৬০০ সাল থেকে ২১০০ সালের যেকোনো তারিখ বললে দুই মিনিটে কতগুলো শুদ্ধ দিন বলতে পারে, ৬ অঙ্কের সংখ্যার বর্গমূল ১০টি ১৫ মিনিটে বের করতে হয়। এই প্রতিযোগিতায় ভারতের ১১ বছর বয়সী প্রিয়ানশী সোমানি ২০১০ সালে বিজয়ী হয়েছিল এবং ২০১৪ সালে ভারতের গ্রন্থ ঠাকার। ২০১৬ সালে এর বিজয়ী জাপানের ইউকি কিমুরা। ২০১৮ সালে আবার এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের কোনো প্রতিযোগী আগামীবার জার্মানিতে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে কি?
আমাদের গণিত উৎসবের সাফল্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের সময়োপযোগী সমন্বয় ঘটেছে। অত্যন্ত মেধাবী তীক্ষ্ণধী বিজ্ঞ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর ছায়ায় দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও গণিত অলিম্পিয়াডকে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়নি। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপস্থিতি চুম্বকের মতো ছেলেমেয়েদের গণিত অলিম্পিয়াডে আকর্ষণ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুনির হাসানের অত্যন্ত উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী অনুষ্ঠান পরিচালনা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা। প্রথম আলোর বন্ধুসভা, মুভার্স ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের উদার পৃষ্ঠপোষকতা আমাদের বহুদূর এগিয়ে দিয়েছে। ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষানুরাগীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ গণিত উৎসবকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তবে আমাদের দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে বেড়ে ওঠা ছাত্ররা গণিত অলিম্পিয়াডের চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করার জন্য যার অবদান অবিচ্ছেদ্য সে হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় হওয়া এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড আর কেমব্রিজে শিক্ষা পাওয়া অনুকরণীয় দেশপ্রেমে আলোকিত এবং দেশপ্রেমের আলো বিকিরণকারী ড. মাহবুব মজুমদার, যিনি আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের দলনেতা হিসেবে আমাদের ছাত্রদের শুধু উচ্চতর পর্যায়েই নিয়ে যাননি, তাঁদের মধ্যে অবিরত দেশপ্রেমের বীজ রোপণ করে চলেছেন এবং সর্বোপরি এই মর্যাদাকর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
আশা করি আমাদের স্কুল–কলেজের ছাত্র তাদের মেধা শাণিত করে সব অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তাদের মেধার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে গোটা জাতিকে উজ্জীবিত করবে, অচিরেই মেধাভিত্তিক কর্মকাণ্ডে আমাদের দেশ বিশ্বসভায় সুপরিচিত হবে এবং জ্ঞান–বিজ্ঞান প্রযুক্তির হাত ধরে বাংলাদেশ সমৃদ্ধিশালী দেশে পরিণত হবে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।