গান যখন যুদ্ধের সংকেত

ঢাকা সেনানিবাসে মুক্তিযুদ্ধের ‘বিজয় কেতন’ সংগ্রহশালায় নৌ-কমান্ডোদের সেই রেডিওর একটি l ছবি: সংগৃহীত

এক ব্যান্ডের আটটি রেডিও। তাকে ঘিরে ১৬০ জন তেজি যুবকের প্রতীক্ষা—কখন বেজে উঠবে সেই গান। তবে সবাই এক জায়গায় নয়, চট্টগ্রাম বন্দরে ৬০ জন, মংলা বন্দরে ৬০ জন, চাঁদপুর নৌবন্দরে ২০ জন ও নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরে ২০ জন। চারটি দলের কাছে দুটি করে রেডিও। সবার বুক দুরু দুরু কাঁপছে, কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, বেজে উঠবে সেই গান-সংকেত।
১৩ আগস্ট সকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে বেজে উঠল গান, ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’। এটিই সংকেত। শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। এরপর ১৪ আগস্ট আরেকটি গান বাজলেই পাওয়া যাবে অভিযানে নামার চূড়ান্ত সংকেত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে খ্যাত।

কিন্তু ১৪ আগস্ট আর সেই গান বাজল না, বাজল ১৫ আগস্ট, পংকজ মল্লিকের কণ্ঠে, ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’। ব্যস, অকুতোভয় নৌ-কমান্ডোরা অভিযানে নামার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। চারটি বন্দরেই একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন হলো। মধ্যরাতের পর নৌ-কমান্ডোরা গামছা দিয়ে বুকে মাইন বেঁধে পানিতে নেমে যান, পায়ে ছিল ফিঞ্চ, কোমরে ডেগার। মাঝপথে শত্রুর মুখে পড়লে আত্মরক্ষার জন্য ছিল শুধু ওই ডেগার, ছিল না কোনো আগ্নেয়াস্ত্র। তবে ভূমিতে গেরিলা যোদ্ধাদের একটি দলকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কাভার দেওয়ার জন্য মোতায়েন করা হয়েছিল নদীর তীরে।
কমান্ডোরা প্রায় একই সময়ে চারটি বন্দরে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেন। পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে এটা এক অনন্য নজির।

অপারেশন জ্যাকপটে অংশগ্রহণকারী কমান্ডোদের যে অংশটা মংলা বন্দরে অভিযান চালিয়েছিল, নৌ-কমান্ডো মো. খলিলুর রহমান ছিলেন সেই দলের ডেপুটি কমান্ডার। তিনি নিজেও ৩০০ গজ সাঁতরে জাহাজে মাইন লাগিয়েছিলেন। ৪৪ বছর পরও সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি শিউরে উঠছিলেন।
এই নৌ-কমান্ডো দলের ৩১৫ জনের মধ্যে পাকিস্তান নৌবাহিনীর দলত্যাগী বাঙালি সদস্য ছিলেন মাত্র আটজন, যাঁরা কিছুদিন আগেই ফ্রান্সের প্যারিসে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। আর অন্যরা ছিলেন সাধারণ যুবক। খলিলুর রহমান বলেন, প্রশিক্ষণের সময় কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁদের প্রশিক্ষণ শিবিরে গিয়েছিলেন।
ঢাকা সেনানিবাসে মুক্তিযুদ্ধের ‘বিজয় কেতন’ সংগ্রহশালায় বিভিন্ন স্মারকের মধ্যে নৌ-কমান্ডোদের সংকেত শোনার একটি রেডিও রাখা আছে। এটির সামনে দাঁড়ালে কমান্ডোদের মনে পড়ে যায় সেদিনের সেই রুদ্ধশ্বাস অভিযানের কথা।