গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়ন করতে হবে

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

সন্তান লালনপালন থেকে শুরু করে নারী ঘরে যে কাজ করেন, তার মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি না থাকলে নারীর অবস্থা ও অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে না। নারীর প্রতি সহিংসতাও দূর করা সম্ভব হবে না।
প্রথম আলো আয়োজিত ‘নারীর মজুরিবিহীন শ্রমের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। গতকাল রোববার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সহায়তা করে মর্যাদায় গড়ি সমতা প্রচারাভিযান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থা মাত্রা। বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বৈঠকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) করা এক গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে জানানো হয়, নারীর যে কাজ মোট দেশজ আয় বা জিডিপিতে যোগ হয় না, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে সে ধরনের কাজের আনুমানিক বার্ষিক মূল্য জিডিপির প্রায় ৭৬.৮ শতাংশের সমান ছিল।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নারীর গৃহশ্রমের মূল্যায়ন করলে টাকার অঙ্কে জিডিপির মাত্রা বাড়বে। তবে জিডিপি বাড়লেও পণ্যের মোট সরবরাহ ও সেবা বাড়বে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও নারীর অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।
আজিজুল ইসলাম বলেন, একদিকে গৃহশ্রমের স্বীকৃতি নেই, অন্যদিকে যাঁরা কাজ করেন একই ধরনের কাজের জন্য তাঁরা মজুরি বৈষম্যের শিকার। মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮, যদিও বিধিতে বিশেষ কারণ হলে সরকার বিয়ের বয়স ১৬ বছর করার চিন্তাভাবনা করছে। তিক্ত সামাজিক বাস্তবতা হলো, মেয়ের বয়স ১৮ বছর পার হলে এবং বিয়ে না হলে পরিবার তাঁকে বোঝা মনে করে। তালাকপ্রাপ্ত নারীদের সমাজ সম্মানের চোখে দেখে না। এ ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। তিনি বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের পুরুষ শ্রমিকদেরও শ্রম আইনের আওতায় আনা কঠিন।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) শামসুল আলম বলেন, নারীর কাজের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতির দাবি ন্যায্য। জাতিসংঘের ২০১৫-পরবর্তী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) বিষয়টি সেভাবে স্পষ্ট করে বলা না হলেও নারীদের বিভিন্ন সেবার মাধ্যমে সহায়তা করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও বিষয়টি এসেছে।
শামসুল আলম নারী ও পুরুষের কাজের বৈষম্যকে সামন্তবাদী চিন্তার প্রকাশ বলে উল্লেখ করে বলেন, বাজারভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশ, অধিকার ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন হলে এ ধরনের বৈষম্য বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না।
বৈঠকের শুরুতে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী বনশ্রী মিত্র নিয়োগী মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ২০১২ সাল থেকে করা মর্যাদায় গড়ি সমতা প্রচারাভিযানের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নারীরা বাইরে শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। তবে গৃহস্থালির কাজের ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়নি। ফলে নারীকে ঘরে ও বাইরে কাজ করতে হচ্ছে।
এ প্রচারাভিযানের আওতায় ২০১৪ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং সিপিডি ৬৪ জেলায় ‘জাতীয় অর্থনীতিতে নারীদের অবদান নিরূপণ: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক গবেষণা করে। সিপিডির রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান এ গবেষণার বিভিন্ন ফলাফল তুলে ধরেন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। ২০১০ সালের ৩৬ শতাংশ থেকে ২০১৩ সালে তা ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে। বর্তমানে প্রায় আড়াই কোটি নারী শ্রমিককে শ্রমবাজারে আনতে হলে ঘরের যে মজুরিবিহীন কাজ আছে, তাতে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
জিডিপিতে নারীর গৃহস্থালির হিসাব এই মুহূর্তে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব না হলেও প্যারালাল বা পাশাপাশি হিসাবে তা মূল্যায়ন করার সুপারিশ করেন তৌফিকুল ইসলাম খান। এতে করে নারীর অবদানের স্বীকৃতি মিলবে।

প্রথম আলোর কার্যালয়ে গতকাল ‘নারীর মজুরিবিহীন শ্রমের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা l ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলোর কার্যালয়ে গতকাল ‘নারীর মজুরিবিহীন শ্রমের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা l ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহসভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নেই। নারী কৃষকদের স্বীকৃতি মেলেনি। এমনকি যে নারীরা শ্রমবাজারে যুক্ত, তাঁদের বেতনও কীভাবে ব্যয় হবে তা কর্তা নির্ধারণ করছেন। তাই নারীদের অধিকার না দিয়ে মনমানসিকতার পরিবর্তন সম্ভব হবে না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন হামিদা হোসেন বলেন, নারীর উৎপাদিত পণ্য বাজার পর্যন্ত যাচ্ছে না। মজুরিবৈষম্যও থেকে যাচ্ছে। তিনি আইনের মাধ্যমে শিশু দিবাযত্ন যত্ন কেন্দ্র তৈরিসহ বিভিন্ন বিষয়ের দিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিআইজিডি) প্রধান গবেষক সিমিন মাহমুদ বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই দেশের নারীরা অনেক এগিয়ে গেছেন। তবে বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন এবং ঘরের ভেতরের কাজের যে বিভাজন তা প্রায় এক জায়গায় আটকে আছে। তিনি বলেন, নারীরা ঘরের কাজে বেশি সময় দিচ্ছেন বলে গুটি কয়েক কাজে বেশি আসছেন। ফলে মজুরি ও নারীর দক্ষতাও কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে পুরুষদের কাছে তাঁদের ধারণা সম্পর্কে জানতে চাইলে ৯৮ ভাগই বলছেন, ঘরের কাজে পুরুষের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তবে বাস্তবতা সে কথা বলছে না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক জ্যেষ্ঠ গবেষক প্রতিমা পাল মজুমদার বলেন, ঘরের কাজ ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে শুধু চিৎকার করলে হবে না। রান্নাঘরে উন্নত প্রযুক্তির প্রবেশ ঘটাতে হবে। উন্নত চুলা বা অন্যান্য প্রযুক্তি থাকলে পুরুষেরাও এ কাজে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। গৃহস্থালির কাজের হিসাব জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা শুধু নারীর মর্যাদা বাড়াবে না, জিডিপির আকারও বাড়াবে। এতে করে ২০২১ সালের আগেই মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় যাওয়া সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম প্রচারাভিযানের কথা উল্লেখ করে বলেন, নারীরা যে এত ব্যাপক কাজ করেন তা অনেক পুরুষ আগে কখনোই চিন্তা করতেন না বলে জানিয়েছেন। তবে প্রচারাভিযানের ফলে সবার মনমানসিকতা পাল্টে গেছে তা নয়। যারা বাল্যবিবাহের শিকার, তাদের কাজের সুযোগ কীভাবে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে, তা চিন্তায় থাকতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের দেশীয় পরিচালক ফারাহ কবির জানান, তাঁর সংগঠনের পক্ষ থেকে গাইবান্ধা ও লালমনিরহাটে নারীদের প্রতিদিনের কাজের হিসাব রাখার জন্য ‘টাইম ইয়ুজ ডায়েরি’ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ এলাকায় কমিউনিটির লোকজনের সহায়তায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সায়মা হক বলেন, নারীর গৃহস্থালির কাজকে শ্রমের আওতাতেই আনা হচ্ছে না। অন্যদিকে প্রায় ৪৭ শতাংশ নারী পারিবারিক শ্রমিক হিসেবে মজুরি ছাড়া কাজ করছেন। একজন নারী ঘরের কাজ করেন নয় ঘণ্টা আর পারিবারিক শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন আরও প্রায় দুই ঘণ্টা। অথচ এ কাজের মাধ্যমে তাঁর সামাজিক ও আর্থিক মূল্যায়ন হচ্ছে না।
মাত্রার ম্যানেজিং পার্টনার আফজাল হোসেন নারীর কাজের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি দিতে আইন ও নীতিতে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি মনমানসিকতা পরিবর্তনের বিষয়ে জোর দেন। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতি জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।