‘গোপন কক্ষে একাধিক ব্যক্তি, আমার দেখার বিষয় নয়’

বাঁশখালী আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে গোপন কক্ষে ভোটারের সঙ্গে আরেক ব্যক্তির উপস্থিতি। জোরপূর্বক নৌকায় ভোটদানের অভিযোগ
ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রামের বাঁশখালী পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে সকাল থেকে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন রয়েছে। নারী-পুরুষ সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ভোটকক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কক্ষের ভেতরেও শান্ত পরিবেশ। পোলিং কর্মকর্তার কাছে নিজের ভোটার নম্বরের বিপরীতে হাতের আঙুলের ছাপ দিয়ে কক্ষের গোপন বুথে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ভোটারের পিছু পিছু কক্ষে ঢুকছেন আরেক আগন্তুক। তিনি মেয়র পদে নৌকায় ভোটদানে বাধ্য করছেন। এসব দেখেও না দেখার ভান করছিলেন নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

বাঁশখালীর ১১টি কেন্দ্রের বেশির ভাগ কক্ষে সকাল থেকে এ চিত্র ছিল সাধারণ। মেয়র পদে নৌকার ভোট নিশ্চিত করার পর অবশ্য সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীকে রায় দেওয়ার উদারতা ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থীর লোকজন দেখিয়েছেন। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পুলিশ ও র‍্যাবের উপস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটলেও কেউ যেন কিছু দেখেননি ভাব।

এ অবস্থায় আজ রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী বিএনপি নেতা কামরুল ইসলাম হোছাইনী ভোট বর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। অবশ্য আওয়ামী লীগ প্রার্থী এস এম তোফাইল বিন হোছাইন ভোট বর্জনকে নাটক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

আজ দুপুর ১২টার দিকে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব জলদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই কাউন্সিলর প্রার্থী আজগর হোসেন ও আরিফ মঈনুদ্দীনের সমর্থকদের মধ্যে হইচই শুরু হয়। এ সময় কেন্দ্রের বাইরে কয়েকটি ফাঁকা গুলির শব্দ শোনা যায়। তা দেখে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে পৌঁছান পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। র‌্যাব-৭–এর একটি দলও ঘটনাস্থলে যায়। তাঁরা পরিস্থিতি শান্ত করেন। তখনো কেন্দ্রটিতে নারী-পুরুষের দীর্ঘ লাইন।

এ কেন্দ্রে মোট ভোটকক্ষ আটটি। ৫ নম্বর কক্ষটিতে নারীদের দীর্ঘ লাইন ছিল। নারীরা ভোট দিতে যখন গোপন কক্ষে ঢুকছিলেন, তখন দেখা যায়, মাস্ক মুখে দেওয়া এক যুবক তাঁদের পিছু নেন। তিনি গোপন কক্ষে ঢুকে নৌকার ভোটটি নিশ্চিত করছিলেন। ভোট দিয়ে বের হওয়া দুই নারী জানান, তাঁদের মেয়র পদে বাটন টিপতে দেওয়া হয়নি। কাউন্সিলর ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ভোট দিয়েছেন কেবল।

এ সময় কক্ষের বাইরে একটি টেবিলের ওপর দুই পা তুলে বসে ছিলেন চট্টগ্রামের পটিয়া রেঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারিক রহমান। এই প্রতিবেদক এ বিষয়ে তাঁকে জানালে তারিক রহমান বলেন, ‘গোপন কক্ষে একাধিক লোক থাকলেও ওটা আমার দেখার বিষয় নয়।’

পাশে থাকা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সমরঞ্জন বড়ুয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘কোথায় লোক? আমি দেখছি।’ বলে তিনি কক্ষে ঢুকে ওই যুবককে ভোটারদের সঙ্গে গোপন কক্ষে ঢুকতে বারণ করেন। তবে তাঁর মৃদু বারণ যেন ওই যুবক শুনতেই পাননি। পরবর্তী ভোটারের সঙ্গে তিনি আবারও নৌকার ভোটটি নিশ্চিত করেন।

বাইরে তখনো র‌্যাব–পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি। কিন্তু ওই কেন্দ্রের প্রতিটি কক্ষে একজন করে আগন্তুক উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা গোপন কক্ষ পাহারা দিচ্ছিলেন। বেলা একটার দিকে বাঁশখালী আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। এখানে ১০টি কক্ষে মোট ভোটার ৩ হাজার ২১৯। ৫ ঘণ্টায় ৪৫ শতাংশ ভোট এখানে হয়ে গেছে বলে জানান প্রিসাইডিং কর্মকর্তা অধ্যক্ষ মো. ফারুক।

এখানকার ৭ নম্বর কক্ষের গোপন কক্ষটি দরজা থেকেই দেখা যাচ্ছিল। এই নারী কক্ষটিতে প্রত্যেক ভোটারের সঙ্গে সঙ্গে গোপন কক্ষে এক যুবক ঢুকে নৌকার ভোট নিশ্চিত করছিলেন। এ–সংক্রান্ত একাধিক ছবি প্রথম আলোর কাছে রয়েছে।

জানতে চাইলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. ফারুক পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি দেখেছেন? আমার চোখে পড়লে আমি কিন্তু কাউকে কেন্দ্রে থাকতে দিচ্ছি না। তারপরও যদি হয়, আমি দেখছি।’

একই কেন্দ্রের আরও তিনটি কক্ষে একই চিত্র দেখা গেছে। দোতলার দুটি পুরুষ কক্ষে দেখা যায়, পুরুষদের সঙ্গে অপর একজন (নৌকার ব্যাজ লাগানো) গোপন কক্ষে ঢুকে বাটন টিপে দিচ্ছেন।

বেলা আড়াইটার দিকে দক্ষিণ জলদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা যায়, একটি কক্ষের সামনে নারীদের ভিড় রয়েছে। ওই কক্ষের গোপন বুথেও একই চিত্র দেখা গেছে। পুরুষদের একটি কক্ষে নৌকার ব্যাজ পরিহিত একজন ভোটারদের পিছু নিচ্ছিলেন।

উত্তর জলদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গোপন কক্ষে ভোটারের সঙ্গে আরেক ব্যক্তির উপস্থিতি। জোরপূর্বক নৌকায় ভোটদানের অভিযোগ
ছবি: সৌরভ দাশ

ভোট দিয়ে বের হওয়া এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা নৌকায় ভোট দিতাম। কিন্তু সেটিও নিজেরা টিপে দিয়েছে। কাউন্সিলর পদে নিজের পছন্দের ভোট দিতে পেরেছি।’
এ বিষয়ে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ফয়সাল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো ঝামেলা হয়নি। কোনো হতাহত নেই। সুষ্ঠু সুন্দর ভোট হয়েছে। গোপন কক্ষে একাধিক লোক আমরা দেখতে পাইনি।’

এই যখন অবস্থা, তার আগেই বেলা সাড়ে ১১টায় কামরুল ইসলাম হোছাইনী পৌরসভা মাঠে সাংবাদিকদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তিন বলেন, কোনো কেন্দ্রে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। নারী ও পুরুষের লম্বা লাইন থাকলেও ভোট দিতে দেওয়া হচ্ছে না। এটি ভোট নয়, ভোট ডাকাতির মহোৎসব চলছে।

নৌকার মেয়র প্রার্থী তোফাইল বিন হোছাইন বলেন, পরাজায় নিশ্চিত জেনে তিনি ভোট বর্জনের নাটক করেছেন।

নির্বাচনে মেয়র পদে ২ জন, সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ১০ জন এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৪৪ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মোট ভোটার ২৬ হাজার ৯৮০ জন।