‘গোল্ডেন মনিরের’ বিরুদ্ধে মামলায় আসামি সিরাজগঞ্জ আ. লীগের নেতা

মনির হোসেন ওরফে ‘গোল্ডেন মনির’কে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব
ফাইল ছবি

সোনা চোরাচালানসহ ‘নানা অপকর্মের’ মাধ্যমে ঢাকায় ডজনখানেকের বেশি বাড়ি–গাড়ি এবং কয়েক শ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির। তাঁর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

মামলায় মনিরের স্ত্রী, বোন–ভগ্নিপতি ও ছেলেকেও আসামি করা হয়েছে। তাঁকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার অভিযোগে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক রিয়াজ উদ্দিনকে (৬৩) আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া রিয়াজের ভাই হায়দার আলী (৫৬), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিককেও (৫২) আসামি করা হয়েছে।

সিআইডির পরিদর্শক মো. ইব্রাহিম হোসেন আজ মঙ্গলবার বিকেলে বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় এই মামলা করেন। পাঁচ মাস সরেজমিন অনুসন্ধান করে সিআইডি কর্মকর্তা ইব্রাহিম গোল্ডেন মনির ও তাঁর সহযোগীদের বিষয়ে এসব তথ্য পেয়েছেন বলে জানা গেছে।

সিআইডি বলছে, অপরাধলব্ধ আয় দিয়ে গোল্ডেন মনির স্ত্রী, ছেলে এবং তাঁর নিজের নামে সরকারি ২০টিসহ ৩০টি প্লট, ১৫টি ভবন, ১টি আবাসন প্রতিষ্ঠান এবং ২টি গাড়ির শোরুম করেছেন। ব্যাংকে তাঁর নামে রয়েছে ৭৯১ কোটি টাকা। এর সবই তিনি নানা অপকর্মের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে মামলায় বলা হয়েছে।

বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম প্রথম আলোকে মামলা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মামলায় মোট ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। অপর আসামিরা হলেন গোল্ডেন মনিরের সহযোগী আবদুল হামিদ (৬০), মনিরের স্ত্রী রওশন আক্তার, ছেলে রাফি হোসেন, বোন নাসিমা আক্তার, নাসিমার স্বামী হাসান আলী খান, মনিরের আরেক ভগ্নিপতি নাহিদ হোসেন।

এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা অপরাধের মাধ্যমে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। তাঁরা এসব অর্জিত সম্পদ জ্ঞাতসারে গ্রহণ করে ভোগদখল করছেন।

গত বছরের ২০ নভেম্বর রাজধানীর মেরুল বাড্ডার বাসায় অভিযান চালিয়ে মনিরকে মাদক, অস্ত্রসহ আটক করে র‍্যাব। গ্রেপ্তারের পর তাঁর বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়। এ ছাড়া মতিঝিল ও রমনা থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য ও দুদক আইনে আরও চারটি মামলা রয়েছে। মনির বর্তমানে কারাগারে।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে থাকা গোল্ডেন মনিরকে মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে। এজাহারভুক্ত বাকি ৯ আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সিআইডির মামলায় বলা হয়েছে, গোল্ডেন মনির সোনা চোরাচালান, জালজালিয়াতির মাধ্যমে ভূমি দখল ও ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করে এত সব অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। পরে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, সিরাজগঞ্জ আওয়ামী লীগের একজন নেতাসহ সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যদের সহযোগিতায় বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ ও নিজ স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে লেনদেন ও স্থানান্তরের মাধ্যমে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হন।

অপরাধলব্ধ আয় দিয়ে গোল্ডেন মনির উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডে গ্র্যান্ড জমজম টাওয়ার এবং উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের সাফা টাওয়ারের অন্যতম মালিক হন। ঢাকায় তাঁর ৯০ কাঠার বিভিন্ন আয়তনের সরকারি ২০টিসহ ঢাকা ও কেরানীগঞ্জে ২৫টি প্লট রয়েছে। তার মধ্যে বাড্ডায় রাজউকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) আড়াই কাঠার ১৯টি প্লট, রাজউক পূর্বাচলে ১০ কাঠার একটি প্লট, বারিধারা জে ব্লকে সাড়ে ৮ কাঠা করে দুটি প্লট, খিলক্ষেতে পৌনে ২ কাঠার একটি প্লট, তুরাগের নলভোগ মৌজায় ১২ কাঠা জমি রয়েছে। এ ছাড়া গোল্ডেন মনিরের নামে কেরানীগঞ্জের চররোহিতপুরে আড়াই বিঘা জমি রয়েছে। আবাসন প্রতিষ্ঠান স্বদেশ প্রপার্টিজে (বাড্ডা) তাঁর মালিকানা রয়েছে।

গোল্ডেন মনিরের নামে ১২৯টি ব্যাংক হিসাবে ৭৯১ কোটি ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৫২৩ টাকা পাওয়া গেছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মনির এই আয়ের একটি অংশ সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যদের নিয়ে পরস্পর যোগসাজশে যৌথ ও একক নামে ব্যবসায় বিনিয়োগ করে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে রূপান্তর করেছেন। তাঁর মালিকানাধীন অটো কার সিলেকশন লিমিটেডের হিসাব থেকে রাজউক কর্মচারী বহুমুখী কল্যাণ সমিতির হিসাবে পাঁচ কোটি টাকা পাঠানোর তথ্য পাওয়া গেছে, যা সন্দেহজনক।

গোল্ডেন মনিরের এক বোন ও দুই ভগ্নিপতি রাজউকের প্লটগুলো দেখাশোনা ও ভোগদখল করে আসছিলেন। বাড্ডার ডিআইটি প্রকল্পে আড়াই কাঠা করে পাঁচটি প্লটে পাঁচটি ভবন নির্মাণ করে গোল্ডেন মনিরের স্ত্রী রওশন আরা তা ভোগদখল করছেন। অপরাধলব্ধ আয় দিয়ে গোল্ডেন মনির তাঁর ছেলে রাফি হোসেনকে (২৪) কার অটো সেন্টারের মালিকানা দিয়েছেন। রাফি স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে পড়েন।

গোল্ডেন মনিরের সহযোগীদের সম্পৃক্ততা নিয়ে মামলায় বলা হয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিকুল গোল্ডেন মনিরের অপরাধ কর্মকাণ্ডের সহযোগী। তিনি ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পার্কিং ইজারা নিয়ে গোল্ডেন মনিরের সোনা চোরাচালানে সহযোগিতা করেছেন। সোনা চোরাচালানের অবৈধ আয় দিয়েই গোল্ডেন মনির ও তাঁর সহযোগীরা উত্তরায় ১৪ তলা জমজম টাওয়ার নির্মাণ করেছেন, যার একাংশের মালিক ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল। মাদক ও চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর নামে রাজধানীর উত্তরখান ও দক্ষিণখান থানায় তিনটি মামলা রয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পরে সাক্ষাতে কথা বলবেন তিনি।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক রিয়াজ উদ্দিনকে গোল্ডেন মনিরের অপরাধ কর্মকাণ্ডের আরেক সহযোগী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছ। মামলায় বলা হয়েছে, রিয়াজ উদ্দিন ১৯৯৬ সালে সোনালী ব্যাংকের এয়ারপোর্ট শাখায় পিয়ন পদে চাকরি করার সময় গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। পরে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। অপরাধলব্ধ আয় দিয়ে তিনি বহুতল জমজম ও আল সাফা টাওয়ারের অন্যতম মালিক হন। দুটি পোশাক কারখানার মালিকও তিনি। সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে পল্টন ও বিমানবন্দর থানায় দুটি মামলা রয়েছে। ওই মামলায় তিনি দুবার গ্রেপ্তারও হলেও পরে জামিনে মুক্ত হন।

সিআইডির এই অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্যের জন্য মঙ্গলবার বিকেলে রিয়াজ উদ্দিনকে ফোন করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

মামলায় বলা হয়, গোল্ডেন মনিরের অপরাধ কর্মকাণ্ডের আরেক সহযোগী হায়দার আলী আওয়ামী লীগের নেতা রিয়াজ উদ্দিনের ভাই। হায়দার আলীর আয়ের কোনো উৎস নেই। তিনি রিয়াজ উদ্দিনের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তায় গোল্ডেন মনির এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুলের পরস্পর যোগসাজশে সোনা চোরাচালানের অর্জিত আয় দিয়ে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের জমজম টাওয়ার এবং উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের আল সাফা টাওয়ারের অন্যতম মালিক হন।

গোল্ডেন মনিরের সহযোগী আবদুল হামিদ নিজেকে অটো কার সেন্টারের মহাব্যবস্থাপক দাবি করলেও এর সপক্ষে কোনো নিয়োগপত্র দেখাতে পারেননি। তিনি গোল্ডেন মনিরের অপরাধ কর্মকাণ্ডে সরাসরি সহযোগিতা করেছেন। তাঁর ১৫টি ব্যাংক হিসাবে প্রায় সাড়ে ২৮ কোটি চাকা লেনদেনর তথ্য পাওয়া গেছে। এই অর্থ চাকরি থেকে উপার্জিত অর্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।