ঘরে ঘরে ভুতুড়ে বিল, বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে সমন্বয় হবে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবের কারণে সরকার ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তিন মাসের আবাসিক গ্রাহকের বিদ্যুতের বিল নেওয়া বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। গত তিন মাসের যে বকেয়া বিল গ্রাহকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে তা দেখে অনেক গ্রাহক এখন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গত তিন মাসে কোনো গ্রাহকের বিল দশগুন, বারো গুন পর্যন্ত বেশি এসেছে। যে গ্রাহকের বিল আসতো মাসে ৩০০ টাকা তার এসেছে হয়েছে ২৫০০ টাকা, যার বিল আসতো ৩ হাজার টাকা তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকার বিল।

এই চিত্র রাজধানীর দুই বিতরণ সংস্থা ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) এবং বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ৮০টি সমিতির গ্রাহকের। এ ছাড়া একই অভিযোগ উত্তরের কয়েকটি জেলায় বিতরণ সংস্থা নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানী লিমিটেড (নেসকো), দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার বিতরণ সংস্থা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো) এবং দেশের সীমিত এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গ্রাহকদের।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, তিনি অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্স করে সবগুলো বিতরণ সংস্থার প্রধানকে বলে দিয়েছেন গ্রাহক বাড়তি বিল যেন দিতে না হয়। বিদ্যুৎ বিল নিয়ে গ্রাহক অসন্তোষ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। গ্রাহকের অধিকার রয়েছে জানার কেন এমন বিল দেওয়া হচ্ছে; পরবর্তীতে কীভাবে তা সমন্বয় করা হবে সেটিও বলতে হবে। এর ব্যতয় যারা ঘটাবে তারা শাস্তি পাবে।

তা ছাড়া শনিবার বিদ্যুৎ বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, প্রকৃত বিল থেকে যাদের বেশি বিল এসেছে আগামীতে তা সমন্বয় করে নেওয়া হবে। বিজ্ঞপ্তিতে গ্রাহককে উদ্বিগ্ন না হতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা বলছেন, মিটার রিডাররা কখনোই বাসায় গিয়ে বিল করে না। ফলে সমন্বয় কীভাবে করা হবে সেটা স্পষ্ট না। বিদ্যুৎ অফিসের কর্মচারি কর্মকর্তাদের ব্যবহার নিয়েও তারা কথা তুলেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রাহকের সঙ্গে তারা দুর্ব্যবহার করে থাকেন।

সারা দেশে এখন ৯৫ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌছে গেছে। দেশে মোট গ্রাহকের সংখ্যা ৩ কোটি ৬৫ লাখ। এর মধ্যে ২ কোটি ৮৫ লাখ গ্রাহকই আরইবির।

গত ২২ মার্চ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আবসাকিক গ্রাহকদের তাদের মাসের বিদ্যুতের বিল দিতে ব্যাংকে যেতে হবে না। বিদ্যুৎ বিভাগ সম্প্রতি এক হিসেব করে দেখিয়েছে, গ্রাহক বিদ্যুৎ বিল না দেওয়ায় তিন মাসে তাদের ১৫ হাজার কোটি ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই অর্থ তারা সরকারের কাছে বিনাসুদে ঋণ চেয়েছে।

ভুতুড়ে বিল :

রাজধানীর কলাবাগানে থাকেন আরিফুর রহমান। প্রতি মাসে তার দেড় থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা বিল আসে। সে হিসেবে ফেব্রুয়ারি-মার্চ-এপ্রিল এই তিন মাসে মাসে তার সর্বোচ্চ বিল আসার কথা ৬ হাজার টাকা। কিন্তু এবার তার বিল এসেছে এক লাখ টাকা।

রাজধানীর পল্টনে থাকেন মো. মুনিরুজ্জামান। মাসে তিনি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা বিদ্যুতের বিল দেন। সে হিসেবে তিন মাসে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা বিল আসার কথা। তার এবার তিন মাসের গড় বিল এসেছে ৫০ হাজার টাকা।

রাজধানীর দক্ষিণাঞ্চল ও নারায়ণগঞ্জে বিদ্যুৎ বিতরণ করে ডিপিডিসি। রাজধানীর উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ করে ডেসকো। এই দুই বিতরণ সংস্থার মধ্যে ডিপিডিসির গ্রাহকের অভিযোগ বেশি। এখানে ভুতুড়ে বিলের পরিমাণ সব থেকে বেশি হলেও এই বিতরণ সংস্থার কর্তৃপক্ষের কাছে গেলে প্রতিকার না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এরকম অস্বাভাবিক ভুতুড়ে বিল কেন হচ্ছে জানতে চাইলে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ' এ বিষয়ে আমি জাতীর উদ্দেশ্য ভিডিওবার্তায় বক্তব্য দিয়েছি। সেই ভিডিওবার্তা দেখে নিন।' আপনার ভিডিওবার্তা চোখে পড়েনি, মুঠোফোনেই বলুন-এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'আমি এখন মিটিংয়ে আছি। এখন কিছু বলতে পারব না।'

চুয়াডাঙ্গার সদরের নুরনগরের আসলামউদ্দিনের মাসে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা বিল আসে। এবার তাকে ২৫০০ টাকা বিল ধরিয়ে দিয়েছে। তবে তিনি কোনো ঝামেলার মধ্যে যাননি। গ্রামের মানুষ, বিল জমা দেওয়ার শেষ সময় যাওয়ার আগেই তিনি পরিশোধ করেছেন।

একইরকম পরিস্থিতি যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরাম বাগেরহাট সহ খুলনা বিভাগের অন্যান্য জেলাতে। ভুতুড়ে বিলের কারণে সংকটে আছে চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট সহ দেশের অন্যান্য বিভাগের মানুষ।

 ভুতুড়ে বিলের জন্য আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) মঈন উদ্দিন দুঃখ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে কিছু কিছু গ্রাহকের বাড়ি গিয়ে বিল করা সম্ভব হয়নি। সে কারণে কোথাও কোথাও প্রকৃত বিল আসেনি। এতে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আগামীতে এসব বিল প্রকৃত মিটার রিডিং দেখে সব সমন্বয় করা হবে। যদি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে যথাযথ প্রতিকার না পায় কেউ তাহলে আরইবির আর্থিক মনিটিরিং পরিদপ্তরের পরিচালকের মুঠোফোন নম্বর ০১৭১২৫৬১৩৯৭ যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করছি।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে বিল করার ক্ষমতা বিতরণ সংস্থাগুলোর নেই। বিইআরসির বেধে দেওয়া নিয়মের বাইরে এ ধরণের বিল করা হলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জনগনের ওপর এমন অত্যাচার বিতরণ সংস্থাগুলো কোনভাবেই চাপিয়ে দিতে পারে না, এটি অন্যায়।