ঘরোয়া খাবারের নতুন উদ্যোক্তা

গৃহবধূ রেক্সোনা রহমানের হাতের রান্না তাঁর আত্মীয়স্বজন খুবই পছন্দ করেন। তাঁদের পরামর্শে গত বছরের ডিসেম্বরে অনলাইনে খাবার বিক্রির কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। গত এক বছরে প্রতিদিনই তিনি কোনো না কোনো অর্ডার পেয়েছেন। বিশেষ করে করোনাকালে জেলার বিভিন্ন ক্লিনিক, হাসপাতাল ও কোয়ারেন্টিন সেন্টারে নিয়মিত খাবার সরবরাহ করতেন তিনি। ফেসবুকে তাঁর ‘স্পাইস কিচেন’ পেজটি পরিচিত হয়ে উঠেছে।

গত এক বছরের অভিজ্ঞতা বিষয়ে রেক্সোনা রহমান বলেন, ‘শুরুটা হয়েছিল একজন শিক্ষকের কাছে ১২ টাকা দরের ১৫টি অন্থন বিক্রির মধ্য দিয়ে। এক দিনে ৯১ প্যাকেট বিরিয়ানির অর্ডার ছিল সবচেয়ে বড়। একজন চিকিৎসক ৩০০ টাকা দরের খাবারের অর্ডারটি দিয়েছিলেন।’

চুয়াডাঙ্গায় তরুণী ও গৃহবধূদের অনেকেই সংসার ও পড়াশোনার পাশাপাশি উদ্যোক্তার তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন। অনেকে বাড়িতে তৈরি প্রচলিত দেশি এবং বিদেশি খাবারের ব্যবসা করে ঘরে বসেই উপার্জন করছেন। জেলা শহর ছাড়াও আলমডাঙ্গা, দর্শনা ও জীবননগর এলাকার শতাধিক তরুণী-গৃহবধূ বাড়িতে তৈরি খাদ্যপণ্য ও খাবার নিয়েই সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করছেন। এঁদের মধ্যে স্পাইস কিচেনের রেক্সোনা রহমান, ডেলিসিয়াস বাইটের অনামিকা, নিডস ফুডের সিফাত ইসলাম, তাসিফ মেঘ পেজের তন্বী রহমান অন্যতম।

জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বেকারির তৈরি কেকের তুলনায় বাড়িতে তৈরি কেকের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আলমডাঙ্গার সিস্টার্স কিচেনের স্বত্বাধিকারী দিলরুবা এখন কেক তৈরির জন্য সুপরিচিত। তাঁর তৈরি কেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য ফুটিয়ে তোলেন। দিলরুবার পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গা শহরের রুমানা জামান, লোপা কামরুন্নাহার, হেলেনা আক্তার কামনা ও জীবননগরের আফসানা শারমিনের কেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তৃণা আগরওয়ালার তৈরি কেকে পাওয়া যায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশেল চিত্র। এ ছাড়া চাহিদা অনুযায়ী চকলেট তৈরি করে দারুণ সাড়া ফেলেছেন উদ্যোক্তা জারীন তাসনিম। সারা দেশেই রয়েছে তাঁর তৈরি চকলেটের চাহিদা।

স্নাতকের ছাত্রী উদ্যোক্তা সিফাত ইসলাম জানান, শখের বশেই এই কাজ করা। প্রথম দিন ৭টি মোরগ-পোলাও, ৫টি বিফ তেহারি, ২০টি ডিমচপ ও ২৫টি চিকেন ফ্রাই দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এখন পর্যন্ত এক দিনে সর্বোচ্চ ৩০০ প্যাকেট মোরগ-পোলাও অর্ডার পেয়েছেন।

সিফাত বলেন, ‘হোটেল-রেস্তোরাঁয় ব্যবসাকে প্রাধান্য দেয়। আর আমাদের মতো উদ্যোক্তারা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী স্বাদ ও মানকে প্রাধান্য দিই। গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে মতামত জানতে চাই। অনেকেই আমাদের খাবারওয়ালি বলে কটাক্ষ করেন। যাঁরা এগুলো করেন, তাঁদের এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

এসব উদ্যোক্তার কাজে পরিবারের সদস্যরাও সহায়তা করেন। যেমন রেক্সোনা রহমানের কাজে সহায়তা করেন তাঁর দুই মেয়ে রিফা তাসনিয়া ও জারীন সুবাহ। রিফা তাসনিয়া বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচের জন্য বাবার ওপর চাপ অনেকটাই কমেছে। টাকাপয়সার প্রয়োজন হলে আগে বাবার কাছে চাইতাম। এখন মায়ের কাছে চাই।’

এসব উদ্যোক্তা জানান, মূলত করোনার সময়ে ‘অনলাইনে খাবার অর্ডার’ চালু করেন তাঁরা। তবে দিন দিন তা জনপ্রিয় হচ্ছে। অনেকে বাড়ি থেকে টিফিন বা খাবার নিয়ে অফিস-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে চান না। অনলাইনে অর্ডার করলে দ্রুততম সময়ে পছন্দের খাবারটি পৌঁছে যায়। বিশেষ করে ব্যাচেলর ও যেসব চাকরিজীবী পরিবারের সঙ্গে থাকেন না, অনলাইনের খাবার তাঁদের জীবনযাত্রা সহজ করে দিয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা শহরে একটি সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রায় তিন বছর ধরে এ জেলায় চাকরি করছেন। রেস্তোরাঁর খাবার তাঁর শরীরে সহ্য হয় না। নিজেই দুই বেলা রান্না করে খেতেন। অনলাইনে খাবার সরবরাহ চালু হওয়ায় পছন্দ অনুযায়ী মানসম্মত খাবার কিনে খাচ্ছেন। তাঁর সময় ও খরচ দুটোই সাশ্রয় হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনলাইনে খাবার অর্ডার করা হয়। জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘ঘরে তৈরি খাবারের বিষয়ে তরুণী ও গৃহবধূদের উদ্যোগে বরাবরই উৎসাহ দিয়ে থাকি। ইদানীং বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এসব খাবারের প্রচলন দারুণভাবে সাড়া ফেলেছে। খাবারের মানও বেশ ভালো। এই খাতে প্রতিদিন নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছেন। তাঁরা পরিবার, সমাজ ও জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছেন।’