ঘুরে আসুন জাহাজমারা

পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ জাহাজমারা সৈকতকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত করতে রাঙ্গাবালী উপজেলা প্রশাসন নানা উদ্যোগ নিচ্ছে।

সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপ জাহাজমারা। এখানকার পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকত টানছে পর্যটকদেরছবি: প্রথম আলো

চারদিকে সমুদ্রের জলরাশি। সৈকত লাগোয়া জলে নির্বিঘ্নে সাঁতার কাটছে মাছেদের দল। সাগরের ঢেউয়ের তালে তালে ছোট ছোট বিভিন্ন প্রজাতির মাছের দলের ছোটাছুটি চোখে পড়ে। পাখিদের কলরবে মুখর হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। বালুতে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি। ভাটার সময় সমুদ্রসৈকত থেকে জল যখন নামতে শুরু করে, তখন অসংখ্য লাল কাঁকড়া ছুটে চলা মিছিলে পুরো সৈকতজুড়ে আলপনার মতো ফুটে ওঠে। প্রভাতে পূর্বাকাশে সমুদ্রের বুক চিরে লাল সূর্যের জেগে ওঠা, আর সাঁঝবেলায় পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার মতো দৃশ্য যেকোনো জায়গায় দাঁড়ালেই উপভোগ করা যায়।

এমন একটি জায়গার নাম জাহাজমারা। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপ এটি। পটুয়াখালীর সাগরঘেঁষা রাঙ্গাবালী উপজেলায় মৌডুবী ইউনিয়নে সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাহাজমারা সৈকত এখন সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র।

মৌডুবী ইউনিয়নের প্রবীণ লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে জাহাজমারা এলাকার নাম ছিল চরবগলা। বঙ্গোপসাগরের এই জাহাজমারা এলাকাটি ছিল আন্তর্জাতিক নৌরুট। ব্রিটিশ আমলে একটি বিদেশি জাহাজ ওই চ্যানেলে আটকা পড়ে এবং আস্তে আস্তে পলি পড়ে ডুবে যেতে থাকে। স্বাধীনতা–পরবর্তীও সেই জাহাজটি চ্যানেলে দেখা গেছে। তখন থেকেই আশপাশের লোকজন জাহাজটি দেখতে ওই এলাকায় যেতে থাকে। বিদেশি জাহাজ মার খাওয়া থেকেই নামকরণ হয়ে যায় জাহাজমারা।

পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ জাহাজমারা সৈকতকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি করতে রাঙ্গাবালী উপজেলা প্রশাসন ও মৌডুবী ইউপি কার্যালয় থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৯ নভেম্বর প্রথমবারের মতো জাহাজমারা সৈকতে দিনব্যাপী আয়োজন করা হয়েছিল বিচ ফেস্টিভ্যাল। কুয়াকাটাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকেরা এসেছিলেন এখানে। এই বিচ ফেস্টিভ্যাল থেকে দেশের ভ্রমণপিপাসু মানুষকে এখানে বেড়াতে আসার আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া প্রতিবছরেই পর্যটন মৌসুমে প্রচার-প্রচারণাসহ বিচ ফেস্টিভ্যালের আয়োজনের কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাশফাকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের পাশেই কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র। সাগরকন্যা কুয়াকাটায় ভ্রমণে আসা ভ্রমণপিপাসু পর্যটকেরা এক পথেই চলাচল করেন। যে পথে আসেন, আবার সেই পথেই ফিরে যান। কিন্তু জাহাজমারা সৈকত পর্যটকদের কাছে পরিচিতি পেলে পর্যটকেরা ইচ্ছা করলেই কুয়াকাটা থেকে সাগরপথে জাহাজমারা সৈকতে যেতে পারবেন। আবার জাহাজমারা থেকে সোনারচর ঘুরতে পারবেন। সেখান থেকে আবার ভোলার চর কুকরিমুকরি বেড়িয়ে ভোলা দিয়ে তাঁদের গন্তব্যে ফিরতে পারবেন। আমাদের মনে হচ্ছে, এসব কারণে জাহাজমারায় পর্যটকদের আগমন বাড়বে।’

রয়েছে সৈকত–লাগোয়া বন

সমুদ্রতীরে দীর্ঘ সৈকতের পাশে রয়েছে বন বিভাগের ঘন বনাঞ্চল। বন বিভাগ রাঙ্গাবালী রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা যায়, পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজমারা সৈকতের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে এক কিলোমিটারের বেশি সংরক্ষিত বন রয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই সংরক্ষিত বনে কেওড়া, ছৈইলা, বাইন, নিম, খৈয়াবাবলা, বাবলা বলইসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছিল। বর্তমানে সংরক্ষিত জাহাজমারা বনে বিভিন্ন প্রজাতির পাঁচ লক্ষাধিক গাছ রয়েছে।

বন বিভাগ, রাঙ্গাবালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, যেহেতু এখন জাহাজমারা সৈকত পর্যটকদের কাছে পরিচিতি পাচ্ছে এবং পর্যটকদের আগমন ঘটছে, তাই বন বিভাগ থেকে সৈকতকে আরও আকর্ষণীয় করতে ঝাউবাগান করার উদ্যোগ নিয়েছে। পর্যটকেরা এই ঝাউবাগানের ছায়ায় বসে একটু বিশ্রামসহ নির্মল বাতাস নিতে পারবেন।

মৌডুবী ইউপির প্রশাসক ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, নয়নাভিরাম এই সৈকতে পর্যটন মৌসুম এলেই কিছু ট্রলার পর্যটকদের নিয়ে জাহাজমারায় যাতায়াত করে। কুয়াকাটা থেকে কিংবা রাঙ্গাবালী থেকে ট্রলার ও মোটরসাইকেল যাতায়াত বেড়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে পর্যটকেরা এসব স্থানে ছুটে আসছেন। তবে পর্যটকদের নদী ও সড়কপথে সহজ যোগাযোগের পথ সৃষ্টি হলে জাহাজমারা পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

যেভাবে যেতে হবে

জাহাজমারা যাতায়াতের একাধিক পথ রয়েছে। ঢাকার সদরঘাট থেকে বিকেল পাঁচটায় একটি দ্বিতল লঞ্চ রাঙ্গাবালীর উদ্দেশে ছেড়ে আসে। পরদিন ভোরে রাঙ্গাবালীর কোড়ালিয়া লঞ্চঘাট পৌঁছে যাবেন। এই পথের লঞ্চের ডেকের ভাড়া ৪৫০ টাকা। সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া ১ হাজার ৪৫০ টাকা এবং ডাবল কেবিন ভাড়া ২ হাজার ৮০০ টাকা। এ ছাড়া ভিআইপি কেবিনও রয়েছে লঞ্চে। কোড়ালিয়া ঘাট থেকে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে ২০ মিনিটেই রাঙ্গাবালী খালগোড়া বাজার খেয়াঘাট পৌঁছে যাবেন। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা উপজেলা সদর রাঙ্গাবালীতে আবাসিক হোটেল রয়েছে এবং সঙ্গে খাওয়ার ব্যবস্থা। এখান থেকে সকালে জাহাজমারা গিয়ে সারা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসা যায় উপজেলা সদরে।

এ ছাড়া ঢাকা থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আরও দুটি দোতলা লঞ্চ কলাপাড়া পায়রা বন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ভোরে লঞ্চগুলো রাঙ্গাবালীর কোড়ালিয়া ঘাটে ভেড়ে। সেখান থেকেও একই পথে জাহাজমারা সৈকতে যাওয়া যাবে।

এদিকে গলাচিপা থেকেই মৌডুবী পর্যন্ত একতলা লঞ্চ চলাচল করছে। কলাপাড়া উপজেলা থেকে স্পিডবোটে রাঙ্গাবালীর বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের গাইয়াপাড়া ঘাটে গিয়ে মোটরসাইকেলে জাহাজমারা সৈকতে যাওয়া যাবে। এতে জনপ্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়বে।

নদীপথে গলাচিপার পানপট্টি, কলাপাড়া, পায়রা বন্দর, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে ট্রলার ও বিভিন্ন নৌযানে পর্যটকদের যাতায়াত বেড়েছে। তবে সড়কপথে যাতায়াত সহজ করতে উপজেলা প্রশাসন পরিকল্পনা নিয়েছে। গলাচিপার পানপট্টি থেকে রাঙ্গাবালীর কোড়ালিয়া ঘাট পর্যন্ত আগুনমুখা নদীতে ফেরি সার্ভিসের ব্যবস্থা ও রাঙ্গাবালীর খালগোড়া ও চরগঙ্গার মধ্যে প্রবাহিত দাড়ছিঁড়া নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চর গঙ্গা থেকে জাহাজমারা সৈকত পর্যন্ত সড়ক পাকাকরণ করা পরিকল্পনা নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এতে করে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সড়কপথে পর্যটকেরা সহজেই জাহাজমারা সৈকতে যাতায়াত করতে পারবেন।

পর্যটকদের জন্য সৈকত পরিচ্ছন্ন রাখতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মৌডুবী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কার্যালয় থেকে এ জন্য পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সৈকতে বিশ্রামের জন্য যাত্রীছাউনি করে দিয়েছে ইউপি কার্যালয়। এ ছাড়া সুপেয় পানির জন্য সৈকতে বসানো হয়েছে গভীর নলকূপ।

পর্যটকেরা জাহাজমারা ঘুরে এসে রাঙ্গাবালী উপজেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে রাতযাপন করতে পারবেন। এ ছাড়া জাহাজমারা এলাকায় যাতে একটি ডাকবাংলো নির্মিত হয়, এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।