ঘুরে দাঁড়িয়েছে, দেখিয়েছে সাফল্য

করোনা মহামারিতে পুরো জাহাজ নির্মাণশিল্প যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেখানে ডিইডব্লিউ ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয় করেছে ১ হাজার ৬১১ কোটি টাকা।

নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডে নির্মাণের পর শীতলক্ষ্যা নদীতে নোঙর করে রাখা নৌযানছবি: সংগৃহীত

মূলধন ও নেতৃত্বসংকট, লোকসান, শ্রমিক অসন্তোষ, কার্যাদেশ না থাকাসহ নানা কারণে ২০০২ সালে দেশের প্রথম ডকইয়ার্ডটি বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। আর ২০০৬ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ১৫ বছরে দেশের সবচেয়ে লাভজনক ডকইয়ার্ডগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে সেটি। করোনা মহামারিতে পুরো জাহাজ নির্মাণশিল্প যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেখানে নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড (ডিইডব্লিউ) ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয় করেছে ১ হাজার ৬১১ কোটি টাকা।

যাত্রা শুরুর শত বছর: ভারতীয় উপমহাদেশে জাহাজ নির্মাণশিল্পের অন্যতম প্রাচীন প্রতিষ্ঠান ডিইডব্লিউ। প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জের বাণিজ্যিক ঐতিহ্যের সঙ্গে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সম্পর্ক রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সুধীজন পাঠাগারের উদ্যোগে প্রকাশিত নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস বই ও ডিইডব্লিউ সূত্রে জানা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে নারায়ণগঞ্জে আসা পণ্যবাহী জাহাজ ও যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো দীর্ঘ যাত্রার কারণে নিয়মিত মেরামতের প্রয়োজন হতো। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব বাংলায় কোনো ডকইয়ার্ড না থাকায় মেরামতের জন্য নৌযানগুলোকে কলকাতায় কিংবা সিঙ্গাপুরে যেতে হতো। এ সংকট দূর করতেই ১৯২২ সালে ব্রিটিশ সরকার নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতীরে ডকইয়ার্ড গড়ে তোলে। শুরুতে নামকরণ হয় নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড। স্থানীয়ভাবে সোনাকান্দা ডকইয়ার্ড নামে পরিচিত। ১৯৫৬ সালে ডকইয়ার্ডটির নাম পাল্টে ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার ওয়ার্কস লিমিটেড করা হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো এ ডকইয়ার্ড ২০২২ সালে শতবর্ষপূর্তি উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বিশ্বস্ততাই বড় সম্পদ: ২০০৬ সালে শতকোটি টাকার বেশি ঋণ, প্রায় অব্যবহারযোগ্য যন্ত্রপাতি ও ওয়ার্কশপ নিয়ে পুনরায় শুরু করা মৃত প্রতিষ্ঠানটিই আজ দেশের সফলতম ডকইয়ার্ড। প্রায় ২২ একর আয়তনের প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন অন্তত দেড় হাজার শ্রমিক। ২০১৯–২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি একাই ব্যবহার করেছে ২ হাজার ৭০ টন স্টিল, যার বিপরীতে সরকারকে রাজস্ব দিয়েছে ২১৬ কোটি টাকা। ডিইডব্লিউ বর্তমানে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি, বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসিসহ সরকারি–বেসরকারি নানান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করছে।

দায়িত্ব নেওয়ার ১৫ বছরেই এমন পুনরুত্থানের পেছনে নিজেদের বিশ্বস্ততা বড় সম্পদ হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর সৈয়দ মো. মনিরুজ্জামান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই গ্রাহক ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে কাজ করেছি। কাজের গুণগত মান ঠিক রেখে সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে বিশ্বস্ততা অর্জন করেছি। এ বিশ্বস্ততাই আজকের এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে।’ কাজের মানের কারণে প্রতিষ্ঠানটি আইএসও সনদসহ আন্তর্জাতিক বেশ কিছু সনদ অর্জন করেছে বলেও জানান তিনি।

শ্রমিক নিরাপত্তায় অনন্য: দেশের জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতশিল্পের শ্রমিকদের নিরাপত্তাঝুঁকি নতুন কিছু নয়। ন্যূনতম নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়া কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হন শ্রমিকেরা। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতা মন্টু চন্দ্র ঘোষের মতে, ‘নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ডগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি থেকে শুরু করে মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটলেও শ্রমিকেরা শোভন কর্মপরিবেশ পাচ্ছেন না। তবে এ ক্ষেত্রে ভিন্ন ডিইডব্লিউ।’

সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিতে ঘুরে দেখা যায়, ছায়াঘেরা সাজানো–গোছানো ডকইয়ার্ডে শ্রমিকেরা কাজ করছেন। প্রায় সবাই হাতমোজা, বিশেষ জুতা, হেলমেট, বিশেষ ধরনের পোশাক, মুখোশ, নিরাপত্তা চশমার মতো নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করছেন। ডকইয়ার্ডের প্রবেশমুখেই তিনজন শ্রমিকের ছবি ও পরিচয়সংবলিত বড় বিলবোর্ড দেখা যায়।

প্রতিষ্ঠানটির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম, অ্যাডমিন) কমান্ডার নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘এই তিনজন গত বছরের সেরা শ্রমিক নির্বাচিত হয়েছেন। শ্রমিকদের উৎসাহ দিতে প্রতিবছর সেরা শ্রমিক নির্বাচনের এই আয়োজন করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তাই প্রথম’ স্লোগান নিয়ে তাঁরা কাজ করেন। আন্তর্জাতিক শ্রম আইন মেনে শ্রমিকদের জন্য শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য জীবনবিমা, জরুরি চিকিৎসাসেবা, আবাসন ব্যবস্থা, খেলার মাঠ, নিরাপদ ও উন্নত খাবার, বিনোদন ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ ছাড়াও কারখানায় নিরাপদ ও অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া শ্রমিকদের সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিদ্যালয় গড়ে তুলেছে বলেও জানান তিনি।

স্বপ্ন এখন আরও বড়: বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তথ্যমতে, স্বাধীনতার এক বছর পরই ১৯৭২ সালে দেশে প্রথমবারের মতো যুদ্ধজাহাজ তৈরি হয়। বিএনএস পাবনা নামের সেই জাহাজটি নির্মাণ করেছিল ডিইডব্লিউ। বিএনএস পাবনার পর একই শ্রেণির আরও পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করা হয় এখানে। ল্যান্ডিং ক্র্যাফট ট্যাংক, ইনশোর প্যাট্রল ভেসেল, ফাস্ট প্যাট্রল বোট, ড্রেজারসহ ওয়াটার জেটচালিত অ্যালুমিনিয়াম বোট নির্মাণেরও অভিজ্ঞতা আছে প্রতিষ্ঠানটির।

নিজেদের এই সফলতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে জাহাজ রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান সৈয়দ মো. মনিরুজ্জামান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘রপ্তানির জন্য তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। আমরা আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে প্রায় সব ধরনের নৌযান তৈরি করেছি। এই দক্ষতা এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চাই।’ বিদেশে জাহাজ রপ্তানি ছাড়াও দক্ষ জনবল তৈরি ও জাহাজ নির্মাণশিল্পের বিকাশে মেরিটাইম ইনস্টিটিউট ও মেরিটাইম কনসালট্যান্সি সার্ভিস শুরুর প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান তিনি।

ডিইডব্লিউর দেখানো পথে: নারায়ণগঞ্জে জাহাজ নির্মাণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত ৪০ বছরে জেলার বন্দর, ফতুল্লা, সোনারগাঁ ও রূপগঞ্জে ছোট–বড় প্রায় ১০০ জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত কারখানা গড়ে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন খান ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার ওয়ার্কস। খান ডকইয়ার্ডের প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ উদ্দিন খান মনে করেন, ডিইডব্লিউর সফলতা দেখেই এ অঞ্চলের মানুষ জাহাজ নির্মাণশিল্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, শুরুর দিকের ডকইয়ার্ডগুলোতে ডিইডব্লিউ থেকে আসা দক্ষ শ্রমিকেরা কাজ করতেন। তাঁদের হাত ধরেই অদক্ষ শ্রমিকেরা একসময় এ শিল্পে দক্ষ হয়ে ওঠেন।

শত বছর আগে যাত্রা শুরু করা জাহাজ নির্মাণশিল্পে নারায়ণগঞ্জ আজ সারা দেশে অনন্য। ২০০৮ সালে নারায়ণগঞ্জের আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেডের হাত ধরে প্রথম সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানি শুরু করে বাংলাদেশ। তবে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস বইয়ের তথ্যমতে, তারও বহু বছর আগে স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে কুয়েতে চারটি মালবাহী জাহাজ রপ্তানির মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে জাহাজ রপ্তানি শুরু করেছিল শতবর্ষী ডিইডব্লিউ।