চবির পাহাড়ে তিন বছরে ৩২ বার আগুন, তদন্ত নেই

ক্যাম্পাসের পাহাড়ে জ্বলছে আগুন
ফাইল ছবি

২০০৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ শুরু করেছিল। এরপর দেশের বিভিন্ন জেলা–উপজেলা ঘুরে ঘুরে ইনস্টিটিউটের শিক্ষকেরা ১০৯ প্রজাতির উদ্ভিদ সংগ্রহ করে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন। গত ১৫ বছরে সেসব উদ্ভিদের চারা থেকে ২৫ হাজারের বেশি গাছ হয়। কিন্তু সব গাছ রক্ষা করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে ১৫ হাজারের বেশি গাছ মারা গেছে। সর্বশেষ আগুন লাগে গত ১৩ এপ্রিল।

চলতি বছরের ১২ মার্চ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন পাহাড়ে ১৭ বার আগুন লাগে। সর্বশেষ গত ১৬ এপ্রিল ক্যাম্পাসের বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের পেছনে গোলপুকুর-সংলগ্ন পাহাড় আগুন পুড়েছে টানা ছয় ঘণ্টা।

শুধু এ বাগান নয়, গত দুই মাস—মার্চ ও এপ্রিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত সাতটি পাহাড় আগুনে পুড়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ১৭টি। একটি ঘটনারও তদন্ত হয়নি। অগ্নিকাণ্ড রোধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি। কারা পাহাড়ে আগুন লাগাচ্ছে, তা বের করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। কী পরিমাণ গাছপালা পুড়েছে, তা–ও জানার আগ্রহ নেই। ফলে পাহাড়ঘেরা সবুজ শ্যামল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। অবশ্য পাহাড়ে আগুনের ঘটনা একেবারেই নতুন নয়। প্রায় প্রতিবছরই আগুনে পুড়ে সবুজ পাহাড় বিবর্ণ হয়েছে। তবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এখন আগের চেয়ে বেড়ে গেছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত তিন বছরে অন্তত ৩২ বার আগুনে পুড়েছে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পাহাড়। এতে বড়-ছোট গাছপালা, পাহাড়ি কীটপতঙ্গ, জঙ্গল পুড়ে ছাই হয়েছে।

পুড়ে ছাই বিপন্ন প্রজাতির গাছ

বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট থাকার সময় বাংলাদেশ সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ট্রপিক্যাল ফরেস্ট কনজারভেশন প্রকল্পের চুক্তি হয়। ওই চুক্তির অধীনে ২০০৬ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ শুরু করে। আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজটি যৌথভাবে করে আসছিল তারা। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের গবেষক দল দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ঘুরে ১০৯ প্রজাতির বিপন্ন উদ্ভিদ সংগ্রহ করে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন। এসব উদ্ভিদ রোপণ করা হয় জীববিজ্ঞান ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের মাঝখানের জাঙ্গালিয়া পাহাড়ে। রোপণ করা বিপন্ন উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে সাদা গর্জন, সাম্পান, বুটিয়া গর্জন, তেলসুর, চম্পা, বাঁশপাতা, সিভিট, বুদবুদিয়া, থারমারা, চিকরাশি, চিটাগাং উড, তেজ বহল, কস্তুরি, বহাল, হারগাজা, আজুলি, ধলি-গর্জন, ডুলাইয়া-গর্জন, বাইট্টা-গর্জন, শিল-গর্জন, কুদিবারেলা, লাউবারেলা প্রভৃতি।

এরপর বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের চারা থেকে ২৫ হাজারের বেশি গাছ হয়। কিন্তু সব গাছ রক্ষা করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

আক্ষেপ করে প্রকল্পটির তত্ত্বাবধায়ক ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদগুলো রক্ষা করার জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে আসি। কিন্তু এখানে যে গাছগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে, তা আমরা বুঝতে পারিনি। ২০১৮ সালে বাগানে প্রথম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেই থেকে ২০২১ পর্যন্ত আটবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১৫ হাজার গাছ পুড়ে ছাই হয়েছে।’

মোহাম্মদ কামাল হোসাইন বলেন, ‘এ গাছপালাকে ঘিরে বাগানে বিভিন্ন প্রাণী, কীটপতঙ্গের আবাস গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ভয়াবহ আগুনে সব শেষ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আগুনের বিষয়ে জানালেও কোনো কাজ হয়নি।’

২ মাসে ১৭ বার আগুন

চলতি বছরের ১২ মার্চ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন পাহাড়ে ১৭ বার আগুন লাগে। সর্বশেষ গত ১৬ এপ্রিল ক্যাম্পাসের বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের পেছনে গোলপুকুর-সংলগ্ন পাহাড় আগুন পুড়েছে টানা ছয় ঘণ্টা। বেলা দুইটায় আগুন লাগলেও রাত আটটায় তা নেভাতে সক্ষম হন হাটহাজারী ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা। এর আগে ৪ এপ্রিল মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের পাহাড়ে টানা চার ঘণ্টা আগুন জ্বলে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি নিজের শক্তিতে প্রাণপ্রকৃতি রক্ষা করতে না পারে, তবে সরকারকে জানানো উচিত। কারণ, সংঘবদ্ধ চক্রের হাত থেকে পাহাড় বাঁচাতেই হবে।
মু. সিকান্দার খান, শিক্ষাবিদ

বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, নিরাপত্তাকর্মী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে অগ্নিকাণ্ডের মোটামুটি দুটি কারণ জানা গেছে। তাঁরা বলছেন, পাহাড়ে স্থানীয়রা বহু বছর ধরে চাষ করেন। তাঁরা প্রথমে আগুন লাগিয়ে পাহাড় ও সমতলের জঙ্গল পরিষ্কার করে নেন। এতে চাষ করতে সুবিধা হয়। আরেক পক্ষ গাছ কাটতে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেয়। জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে গেলে গাছ কেটে সহজে নেওয়া যায়। এভাবে গত চার বছরে ক্যাম্পাসের আশপাশের পাহাড় থেকে অন্তত সাত হাজার গাছ কাটা হয়েছে।

মাথাব্যথা নেই কর্তৃপক্ষের

বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি। ক্ষয়ক্ষতিও নিরূপণ করে না। এমনকি থানায় সাধারণ ডায়েরিও করে না কর্তৃপক্ষ।

শিক্ষকেরা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদ্‌ঘাটন, জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নেই। কারণ, এখনো দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ তারা নিতে পারেনি। ফলে বারবার পাহাড়ে আগুন লাগিয়ে স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। কর্তৃপক্ষের কাজ হলো আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেওয়া। এর বেশি তারা কিছুই করে না।

তবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা থামাতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়ে অনেকেই চাষ করেন। তাঁদের মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। এবার যাঁরা পাহাড়ে চাষ শুরু করবেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হবে। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে যারা আগুন লাগাচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করার সুযোগ কম। তাই সবার সহযোগিতা ছাড়া এত বড় ঘটনা সমাধান করা সম্ভব নয়।

তদন্ত কমিটির বিষয়ে তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি আদতে কোনো কাজ করতে পারবে না। অগ্নিকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের অনেকেই চেনেন, কিন্তু নাম প্রকাশ করতে চান না​। সার্বিক বিষয়ে জানতে উপাচার্য শিরীণ আখতারকে বেশ কয়েকবার কল করেও সাড়া মেলেনি।

বারবার পাহাড়ে আগুন লাগায় হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। পাখি, কীটপতঙ্গ, সাপ, হরিণ, বানর তাদের আবাস হারাচ্ছে।

বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি। ক্ষয়ক্ষতিও নিরূপণ করে না। এমনকি থানায় সাধারণ ডায়েরিও করে না কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. ফরিদ আহসান বলেন, ক্যাম্পাসের আশপাশের পাহাড়ি অঞ্চলে একসময় ৩৫ প্রজাতির সাপ, ১৬ প্রজাতির ব্যাঙ, ১৮ প্রজাতির টিকটিকি ও গিরগিটি, ২০০ প্রজাতির পাখিসহ অন্যান্য প্রজাতির বন্য প্রাণী ছিল। বারবার আগুন লাগার কারণে এসব বন্য প্রাণী বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।

জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ মু. সিকান্দার খান প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাম্পাসের পাহাড় দেখভালের দায়িত্ব নিরাপত্তা দপ্তরের। দপ্তরের নিরাপত্তাকর্মীরা ঠিকভাবে কেন কাজ করছেন না, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি নিজের শক্তিতে প্রাণপ্রকৃতি রক্ষা করতে না পারে, তবে সরকারকে জানানো উচিত। কারণ, সংঘবদ্ধ চক্রের হাত থেকে পাহাড় বাঁচাতেই হবে।