চলচ্চিত্রে বড় অর্জনের কান্ডারি

আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের কথা আমি প্রথম শুনি আমার বন্ধু ও চলচ্চিত্র নির্মাতা তানিম নূরের কাছে। সম্ভবত ২০১৫ সালের শেষের দিকে। তখন আমি সদ্য ঢাকায় ফিরেছি কোরিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব আর্টস থেকে পড়াশোনা শেষ করে। সে সময়ই জানতে পারি, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন ছাত্র, যাঁর নাম সাদ, একটা ছবি বানিয়েছেন। ছবির নামটি তখনো জানতাম না। কিন্তু তত দিনে নিকেতন হাউজিং সোসাইটির মিডিয়া অফিসগুলোতে তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয় এবং ওঁর সাদা-কালো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটির ব্যাপারে টুকটাক আগ্রহও দেখা যায়।

সাদ সম্পর্কে যতটুকু জানি, তিনি খানিকটা ঘরকুনো এবং খুব নিজস্ব পরিণ্ডল ছাড়া আড্ডা দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। এ জন্য ওঁর দেখা পাওয়াও বেশ দুষ্কর। ঢাকায় এমননিতেই সিনেমা নিয়ে আড্ডা বা চলচ্চিত্রের মানুষজনের সঙ্গে যোগসূত্রতার তেমন কোনো সুযোগ নেই। কাজেই ২০১৬ সালে সাদের প্রথম চলচ্চিত্র লাইভ ফ্রম ঢাকা যখন সিঙ্গাপুর চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত হয়, তখন অব্দি তাঁর সম্পর্কে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন তথ্য ছাড়া, সেভাবে কিছুই জানতে পারিনি।

সিঙ্গাপুর চলচ্চিত্র উৎসবে সাদের প্রথম ছবি সেরা নির্মাতার পুরস্কার পায়। ছবির প্রধান চরিত্র মোস্তফা মনোয়ার পান সেরা অভিনেতার পুরস্কার। এ ব্যাপারটি তখন অন্য সবার মতো আমার জন্যও আনন্দদায়ক ছিল। আমি যখন তারেক মাসুদের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করতাম, তখন সব সময় একটি কথা বলতেন তারেক ভাই: কোনো একটি দেশে এক বা দুজন চলচ্চিত্র নির্মাতা দিয়ে কখনোই ওই দেশের সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি হবে না। সামগ্রিক পরিবর্তন যদি আনতে হয়, তবে অবশ্যই একটি দেশে একসঙ্গে ৩০-৪০-৫০ জন চলচ্চিত্র নির্মাতার নানা বিষয় ও ঢঙের মৌলিক বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প বলার চেষ্টা থাকতে হবে।

সাদের ছবির কিছুদিন আগেই ২০১৪-এর অক্টোবরে বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘নিউ কারেন্টস উৎসব’-এ প্রথম বাংলাদেশি ছবি হিসেবে জালালের গল্প প্রদর্শিত হয়েছিল। ২০১৫-১৬ সালে তখনো ছবিটি নিয়ে আমি বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিচ্ছি। সেই সময় আরেক সহ-নির্মাতার ছবির সিঙ্গাপুর চলচ্চিত্র উৎসবের এই বিজয়কে আমার নিজের বিজয় বলেই মনে হয়েছে।

এরপর তো কত ঘটনা—পৃথিবীতে কোভিড হানা দিল। আর এই করোনাময় দিনেই আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের রেহানা মরিয়ম নূর কান চলচ্চিত্র উৎসবের ২০২১-এর মূল আসরে—প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে ‘আঁ সার্তেঁ রিগা’ বিভাগে প্রদর্শনের জন্য মনোনীত হলো। একে আমি কেবল সাদের অর্জন হিসেবে দেখি না, বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকার হিসেবে এটি আমাদের সবারই অর্জন। দেশের জন্য বড় গৌরবের ব্যাপার।

২০০৯-১০-এর পরবর্তী সময়ে আমাদের চলচ্চিত্রে নতুন ধরনের গল্প বলার একটা জোয়ার আসে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার টেলিভিশন, আমার জালালের গল্প, বিজন ইমতিয়াজের মাটির প্রজার দেশে, রুবাইয়্যাৎ হোসেনের আন্ডার কন্সট্রাকশন, ইশতিয়াক জিকোর ৭২০ ডিগ্রি—বিষয়বস্তুর থেকে দিক বৈচিত্র্যময় এসব সিনেমা পৃথিবীর মানচিত্রে এক এক করে বাংলাদেশের স্বাধীন চলচ্চিত্র হিসেবে স্থান করে নিতে থাকে। তত দিনে কামার আহমাদ সাইমনের শুনতে কি পাও বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পাচ্ছে। এমন একটি সময়ে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ যখন কোনো আওয়াজ ছাড়া লাইভ ফ্রম ঢাকা নিয়ে আমাদের সিনেমা মহলে হাজির হন, আমার কাছে এটিকে অনুপ্রেরণাদায়ক ঘটনা বলেই মনে হয়েছে।

লাইভ ফ্রম ঢাকা ছিল সব দিক থেকে ব্যাতিক্রম। এটি ছিল সাহসী উদ্যোগ। নির্মাণেও প্রতিফলিত হয়েছিল নির্মাতার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। এ ছবিতে নতুন ধরনের বাংলাদেশি গল্প বলার ক্ষেত্রে সাদের যে প্রচেষ্টা, সেটি দেখে আমি অভিভূত হয়েছিলাম।

সেই থেকে সাদ কী করছেন, তাঁর প্রকল্প বা ছবি নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন, প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি কেমন—এসব খোঁজখবর টুকটাক রাখতাম। কিন্তু সম্পর্ক তো একতরফা হয় না। একতরফা হয় কেবল শুভকামনা। আলাপ-পরিচয়বিহীন সাদের প্রতি আমার তাই তখন শুভকামনাই ছিল। আর ছিল তাঁর কাজ দেখার আগ্রহ।

সাদের সঙ্গে আমার প্রথম আড্ডা হয় ২০১৭-এর শুরুর দিকে। সৌভাগ্যক্রমে একদিন সন্ধ্যায় তিনি আমাদের নিকেতনের অফিসে আসেন। দীর্ঘক্ষণের সেই আডায় আমরা যেন এক শতাব্দীর আলাপে মুখর হয়েছিলাম! বাংলাদেশে এরপর তাঁর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি।

দেখা হয়েছিল বুসানে, ২০১৮-তে। তখন বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের এশিয়ান প্রোজেক্ট মার্কেটে অংশ নিয়ে ফান্ড পেয়েছিল সাদের রেহানা মরিয়ম নূর। সে সময় অবশ্য চলচ্চিত্রটির প্রস্তাবিত নাম ছিল ‘আই সি ওয়েভস’। এটি যখন ফান্ড পেল, তখন থেকেই এই প্রকল্পের ব্যাপারে আমার অগ্রহ ছিল। কেননা আমি নিজেও একসময় জালালের গল্প-এর পোস্ট প্রোডাকশনের জন্য এশিয়ান সিনেমা ফান্ড পেয়েছিলাম। অপদার্থ নামে আমার আরেকটি ছবির চিত্রনাট্য উন্নয়নের জন্যও পেয়েছিলাম এই ফান্ড। ফলে সাদের ছবিটির ব্যাপারে আমার আকর্ষণ থাকা স্বাভাবিক।

পরে এই অক্টোবরে বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেই দেখলাম তাঁর রেহানা মরিয়ম নূর। বড় পর্দায় যখন ছবিটি দেখছিলাম, এর প্রতিটি ফ্রেমেই আমি সাদকে পেয়েছি। সেটি তাঁর গল্প বলার প্রক্রিয়া, চিত্রধারণের শৈল্পিকতা, মূল চরিত্রের বিকাশ থেকে শুরু করে সম্পাদনা—সবকিছুতেই। ছবির শেষে চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রের মানসিক অবস্থা যেভাবে উপস্থাপিত হয়, তা আসলে পরিচালকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। ভালো চলচ্চিত্র মূলত সেটিই যেখানে পরিচালকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি সর্বজনীন হয়ে ওঠে। বস্তুত এই সর্বজনীনতাই খোঁজে উৎসবগুলো। চলচ্চিত্রের মধ্যে তারা আসলে সেই জিনিসটিই পেতে চায়, যেখানে একজন রাশিয়ান, জার্মান কিংবা কোনো আফ্রিকান—যে কেউই কেবল গল্পের মাধ্যমেই সবকিছু বুঝতে পারবে। বিশ্ব চলচ্চিত্রের সদা বর্তমান ভাষা এটিই। সাদের ছবিতে চলচ্চিত্রের সেই ভাষা আমরা খুব নিষ্ঠা ও সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশিত হতে দেখি।

আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ

চলচ্চিত্র নির্মাতা

জন্ম

১৯৮৫ সাল, চট্টগ্রাম

পড়াশোনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে

স্নাতক ও স্নাতকোত্তর

চলচ্চিত্র

(২০১৬)

রেহানা মরিয়ম নূর (২০২১)

অর্জন

লাইভ ফ্রম ঢাকার জন্য সিঙ্গাপুর

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালক ও ‘বেস্ট এশিয়ান ফিচার ফিল্ম’ হিসেবে মনোনয়ন (২০১৬)

৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে অফিশিয়াল মনোনয়ন পেয়েছে রেহানা

মরিয়ম নূর (২০২১)

তাঁর একাগ্রতা, চেষ্টা এবং অন্য সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একটি ভালো গল্প বলার জন্য তাঁর যে তাগিদ, তা সত্যিই মুগ্ধকর। সৎ নির্মাতা হিসেবে চলচ্চিত্রের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য মাঝেমধ্যেই তিনি হয়তো সামাজিক আড্ডা বা যোগাযোগ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তাই প্রায়ই আশপাশ থেকে বলতে শুনি, ‘সাদকে পাওয়া যাচ্ছে না।’ এই ব্যাপারটিও কিন্তু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাদের এই প্রস্তুতি নেওয়ার প্রক্রিয়াটিও আমাকে অনুপ্রণিত করে।

নির্মাতাদের মধ্যে যার যার জায়গা থেকে প্রত্যেকেই আমরা চলচ্চিত্রে মৌলিক গল্প বলার চেষ্টা করে আসছি। আমাদের সম্মিলিত চেষ্টায় দেশের চলচ্চিত্রে এখন নতুন দিনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তবে আমরা নিজের জায়গা থেকে যে চেষ্টা করেছিলাম, সেই প্রচেষ্টার প্রথম সফল রূপায়ণের নাম রেহানা মরিয়ম নূর। এই সফলতার পেছনে একটি জিনিসই মূল চাবিকাঠি বলে মনে হয়—নিজের সময়ের সদ্ব্যবহারের চেষ্টা।

রেহানা মরিয়াম নূরকে আমি শুধু কান চলচ্চিত্র উৎসবে অফিশিয়ালি মনোনীত হওয়া চলচ্চিত্র হিসেবে দেখি না। বরং এই নির্মাণের পেছনের গল্পে যা আছে—একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার টিকে থাকার লড়াই, লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে গল্প বলার তাগিদটি ধরে রাখা, চলচ্চিত্রকে নিজের জীবনযাপনের অংশ করে তোলা—প্রতিটি বিষয়েই সাদের কাছে থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

সম্প্রতি ছবিটি অস্কারেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। আগামী ১২ নভেম্বর বাংলাদেশে এটি মুক্তি পাচ্ছে। আশা করি, দর্শকেরা হলে গিয়ে সিনেমাটি দেখবেন। এর কিছুদিন পরে মুক্তি পাবে কয়েকটি চলচ্চিত্র—মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নো ল্যান্ডস ম্যান, কামার আহমাদ সাইমনের শিকলবাহা, রুবাইয়াৎ হোসেনের শিমু, রেজোয়ান শাহরিয়ার সুমিতের নোনা জলের কাব্য, ফজলে রাব্বি মৃধার পায়ের তলায় মাটি নাই, নূর ইমরান মিঠুর পাতালঘর, পিপলু আর খানের নির্মিতব্য কাহিনিচিত্রসহ নতুন আরও অনেক ছবি। তা ছাড়া বিজন ইমতিয়াজের প্যারাডাইস, মাহাদি হাসানের স্যান্ড সিটি, নুহাশ হুমায়ূনের মুভিং বাংলাদেশ, তাহরিমা খানের আমাদের কন্যারাসহ আরও কিছু সিনেমা রয়েছে নির্মাণাধীন অবস্থায়। এই চলচ্চিত্রগুলো আগামী দিনে আমাদের সিনেমার সৃজনশীলতার সীমারেখা কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্ম দেবে। আর এই আলোচনার প্রধান সূত্রধর হয়ে সাদের রেহানা মারিয়ম নূর নতুন চলচ্চিত্রের জোয়ার নিয়ে আসবে, এই কামনা করি।

আবু শাহেদ ইমন : চলচ্চিত্র নির্মাতা