চা-এর গুণাগুণ, নকল চা ও আসল চা

মাত্র ১৭০ মিলিলিটারের এক কাপ চা প্রতিদিনের অ্যান্টি–অক্সিডেন্টের চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ সরবরাহ করতে পারে
ছবি: প্রথম আলো

চা একটি অপেক্ষাকৃত কম ক্যালরিযুক্ত নিরাপদ বিশুদ্ধ পানীয়। এতে চর্বি বা ফ্যাট নেই। তবে এটা পটাশিয়ামসমৃদ্ধ। এটি মুহূর্তেই শরীরে সজীবতা দেয়, সতেজ করে মন, ঝিমুনি ভাব দূর করে, মনঃসংযোগ বৃদ্ধি করে, চিন্তাশক্তি জাগ্রত করে। ক্যানসার ও হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমায়। মাত্র ১৭০ মিলিলিটারের এক কাপ চা প্রতিদিনের অ্যান্টি–অক্সিডেন্টের চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ সরবরাহ করতে পারে। চা সামাজিক বন্ধন ও বন্ধুত্বের প্রতীক। এই পানীয় পান খুব সহজেই একজন মানুষকে আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়।

চায়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সেই আদিকাল থেকে। শতসহস্র স্তুতিবাক্য, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গবেষণাকর্মে চা অন্যতম উপজীব্য। জাপানে চা পান অনুষ্ঠান তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মতোই ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হয়। মার্কিন মনোবিদ মার্ক তুলিনের ভাষায়, ‘এটা সব দেশে বৈধ এবং কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই এটা আমাকে আরও ভালো অবস্থায় নিয়ে আসে।’

কথিত আছে, খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩৭ সালের কোনো এক দিন চীনের সম্রাট শেন নাং রাস্তার পাশে যাত্রাবিরতি করছিলেন। কেটলিতে তাঁর জন্য গরম পানি ফুটছিল। এ সময় পাশের একটি গাছ থেকে কয়েকটি শুকনো পাতা গরম পানির কেটলিতে এসে পড়ে।

চমৎকার নির্যাস ও ঘ্রাণে মোহিত হয়ে সম্রাট সেই পানি পান করেন এবং দেহমনে সজীবতা ও প্রশান্তি লাভ করেন। আর এ ঘটনাই মানবজাতিকে ‘চা’ উপহার দিল। তিনি চায়ের বিভিন্ন ভেষজ গুণ সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং ‘দ্য হারবাল ক্যানন অব শেন নাং’ নামের বইয়ে উল্লেখ করেন যে চায়ের নির্যাস দেহে ৭২ ধরনের বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদানকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা রাখে।

চা–গাছ একটি বহুবর্ষজীবী চিরসবুজ মাঝারি আকৃতির ঝোপাকৃতি বৃক্ষ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Camellia sinensis। পৃথিবীর সব চা–গাছ একই প্রজাতিভুক্ত। তবে এ প্রজাতির কিছু ধরন আছে। চা–গাছের পাতা সরল, একান্তর, কিনারা খাঁজকাটা। ফুল সম্পূর্ণ, উভলিঙ্গ। বৃত্যংশ পাঁচটি, দলাংশ পাঁচটি, পুংকেশর অসংখ্য, পরাগধানী দ্বিকোষী, গর্ভাশয় অধিগর্ভ।

চায়ে পর-পরাগায়ন কার্যকর, স্ব-পরাগায়ন স্বার্থক হয় না। চায়ের কচি পাতা থেকেই চা তৈরি হয়। ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ বাছাইয়ের মাধ্যমে কারখানায় চা তৈরি হয়।

প্রাচীনকালে উঁচু চা–গাছ থেকে বানরের সাহায্যে পাতা বাছাই করা হতো। কালক্রমে চা–গাছকে নির্দিষ্ট উচ্চতায় ছাঁটাই করে ঝোপাকৃতি করে রাখা হয় এবং এটা চা–পাতা সংগ্রহ শুধু সহজ করেছে, তা–ই নয়, এতে উৎপাদনশীলতা ও গুণগতমানও বেড়েছে।

চা–পাতা বাছাই হচ্ছে চা–শিল্পে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও শ্রমঘন কাজ। নারী চা-শ্রমিকেরা পরম যত্নে টিলায় টিলায় দল বেঁধে এ কাজ করেন। তারপর মাথায় করে বা ট্রাক্টরের সাহায্যে সেগুলো চা কারখানায় নিয়ে আসা হয়। কারখানায় চা তৈরির একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলে। এ প্রক্রিয়ায় আছে উইদারিং, রোলিং, ফার্মেন্টেশন, ড্রায়িং ও গ্রেডিং ইত্যাদি। প্রতিটি ধাপে অসাধারণ দক্ষতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ভালো চা তৈরির পূর্বশর্ত।

চা গবেষণায় সুদীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সময় যুক্ত ছিলাম। তাই চায়ের প্রতি ভালোবাসা অকৃত্রিম। এ ভালোবাসার কারণে ইদানীং নকল চায়ের উপদ্রব মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।

কারণ, চা নামটি অপাত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। অতিসম্প্রতি বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে দেখা যায়, পাটপাতা থেকে নাকি চা উৎপাদিত হচ্ছে। তা ছাড়া তেজপাতা চা, এলাচি চা, মরিচ চা, পুদিনা চা ইত্যাদি কত নামে যে ‘চা’ বিক্রি হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। দোকানের শেলফে প্যাকেটজাত বিভিন্ন অদ্ভুত চায়ের সমাহার। ক্রেতার পক্ষে প্রতারিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। চা–পিয়াসীজনদের তাই আসল চা চিনে কিনে নিতে হবে। তা না হলে চায়ের অসাধারণ উপকারিতা থেকে আমরা দূরে সরে যাব।

এ ছাড়া চা–শিল্পে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, আসল চা বিক্রি কমে যেতে পারে। এ বাস্তবতায় চায়ের প্রচার ও প্রসারে যত্নবান হওয়ার পাশাপাশি ‘চা’ নামের সত্তাটিকে টিকিয়ে রাখা যেতে পারে। কারণ, আমরা সবাই আসল চা পান করতে চাই, নকল চা নয়।

সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট