চাঁদপুর পুরান বাজারের প্রতি কোণে হাহাকার

এক পাশে মেঘনা, আরেক পাশে ডাকাতিয়া নদী। মাঝে চাঁদপুরের একসময়ের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র পুরান বাজার। নদীর কারণে একসময় বাজারটি হয়ে উঠেছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র, অথচ মেঘনার ভাঙনেই সেই ঐতিহ্য হারানোর হাহাকার আজ বাজারটির প্রতি কোনায়।
বাজারটির ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, ভাঙনের পাশাপাশি পণ্য ওঠানো-নামানোর ঝুঁকিপূর্ণ ঘাট, জীর্ণ সড়ক আর বেহাল ড্রেনেজ-ব্যবস্থা পুরান বাজারের ভবিষ্যৎকেই শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। এসব কারণে বিনিয়োগকারীরাও এখান থেকে চলে গেছেন।
২২ ও ২৩ ডিসেম্বর পুরান বাজার ঘুরে একদিকে দেখা গেল জৌলুশপূর্ণ অতীতের সাক্ষী বিভিন্ন স্থাপনা, অন্যদিকে বিবর্ণ বর্তমান। মেঘনা, ডাকাতিয়া ও পদ্মা—এই তিন নদীর মোহনায় চাঁদপুর বন্দর। বন্দরটির একসময়ের প্রাণকেন্দ্র পুরান বাজারের অবস্থান মেঘনা-ডাকাতিয়ার মোহনায়। নৌপথের পাশাপাশি সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগের সুবিধাও আছে।
যোগাযোগসুবিধা আছে, তবু কেন অস্তিত্ব নিয়ে এমন হাহাকার, শঙ্কা? কারণ হিসেবে ব্যবসায়ী ও স্থানীয় লোকজন বলেন মেঘনার রাক্ষুসে হয়ে ওঠার কথা। একসময় তিন বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত বাজারটির এক বর্গকিলোমিটার চলে গেছে মেঘনার পেটে। ডাকাতিয়াও কিছু কিছু গ্রাস করছে। ভাঙনরোধে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেই। নদীর কারণে সমৃদ্ধি এলেও এখন মেঘনায় ঘাটই নেই। যেখানে বাঁধ আছে, তার ওপর গড়ে উঠেছে বসতি। ফলে কম ব্যয়ে সহজ যোগাযোগটা কঠিন হয়েছে। এই অসুবিধা বিমুখ করেছে ব্যবসায়ীদের।
ডাকাতিয়া নদীর অন্য পারে চাঁদপুর শহরের আরেক অংশ। সেখানেও পরে গড়ে উঠেছে ব্যবসাকেন্দ্র, নতুন বাজার। আগে দুই পারের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে শহরের দুই অংশের মধ্যে বন্ধন গড়তে ডাকাতিয়ায় নির্মিত হয় সেতু। এতে নতুন বাজারে গতি এলেও এ পারের বাজারে প্রাণচাঞ্চল্য কমেছে।
চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির হিসাব অনুসারে, পুরান বাজারে এখনো ছোট-বড় দুই হাজারের মতো দোকান রয়েছে। আশি-নব্বইয়ের দশকেও বাজারটি ছিল রমরমা। বাজারটি বিখ্যাত ছিল মূলত লবণ-বাণিজ্যের কারণে। চট্টগ্রাম থেকে রেল ও নৌপথে অপরিশোধিত লবণ এখানে আসত। এখানকার প্রায় ৪০টি কারখানায় তা পরিশোধিত হতো। পরিশোধিত লবণ দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা এসে কিনে নিতেন। চাল, ডাল, সিরষাসহ বিভিন্ন শস্যজাতীয় পণ্য ও নিত্যপণ্যের পাইকারি কারবারও ছিল এখানে। পণ্যের নামেই বাজারের সড়কগুলোর নাম। এই বাজার ঘিরে বিনিয়োগকারী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহও ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত পাঁচ-সাত বছরে তিনটি ব্যাংক কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। এখন কৃষি ব্যাংকের শাখাটিও সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।
পুরান বাজার ঘুরে দেখা যায়, মেঘনার ভাঙনের কারণে বাজারের পশ্চিম অংশ বেশি নাজুক। এই অংশেই কালের সাক্ষী হয়ে আছে প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো মন্দির, শতবর্ষী মসজিদ, কারুকার্যময় কয়েকটি দোতলা ও তিনতলা ভবন। বাজারের ভেতরের সড়কগুলো সরু, দুটি রিকশা পাশাপাশি যেতে পারে না, এর ওপর ভাঙাচোরা।
ডালপট্টির মুদিপণ্যের ব্যবসায়ী অশীতিপর দিনেশচন্দ্র সাহা বলেন, ‘এই পুরান বাজার একসময় ছিল বাংলাদেশের নাভি। এইখান থিকাই মাল যাইত উত্তর-দক্ষিণ সবখানে। মেঘনা ভাঙল, আমরা ঠেকাইতে পারলাম না। এখনো যা আছে, তা-ও তো ঠিকঠাক রাখতে পারতাছি না।’
একই সড়কের চাল ব্যবসায়ী বঙ্কিম সাহা বলেন, ‘ব্যাংক ঋণ দেয় না। মাল নামাইতে গিয়া কুলি মরে, বর্ষাকালে রাস্তা দিয়া হাঁটন যায় না। কেডায় এইখানে মাল কিনতে আইব?’
ডালপট্টি থেকে পশ্চিমে এগিয়ে চোখে পড়ল বিস্তৃত মেঘনা। ভাঙন ঠেকাতে সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার অংশে ব্লক বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বাঁধের ওপর বেশ কিছু জেলে পরিবার ও নদীভাঙনের শিকার মানুষ বসতি গড়েছে। একাংশে দেবে যাওয়া প্রায় ৯০ মিটার বাঁধ আবার নির্মাণ করা হচ্ছে।
বাজারের বাতাসাপট্টি, আড়ৎপট্টি, ঘোষপট্টি, সুতাপট্টি, মনোহারিপট্টি, ট্রাংকপট্টি, খলিফাপট্টি, টিনপট্টিসহ আরও কিছু সড়ক ঘুরে ডাকাতিয়ার পাড়ে ভুঁইয়ার ঘাটে এসে বঙ্কিম সাহার কথার সত্যতা মিলল। দেখা গেল, ঘাট থাকলেও তাতে ঘেঁষে বড় নৌকা ভিড়তে পারেনি। ঘাট ও নৌকার মধ্যে সংযোগ স্থাপন হয়েছে কাঠ দিয়ে। এর ওপর দিয়ে শ্রমিকেরা পণ্যভর্তি বস্তা ওঠানো-নামানো করছেন। যেখানে ঘাট নেই, সেখানে শ্রমিকেরা নৌকা থেকে মাথায় বস্তা নিয়ে পাড়ের ব্লকের ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে উঠে আসছেন।
চাঁদপুর চেম্বারের পরিচালক ও পুরান বাজারের চাল ব্যবসায়ী আবুল কাশেম বলেন, ভুঁইয়ার ঘাট ছাড়াও মৌলভীর ঘাট, গাজীর ঘাট ও পাইট্টাল পট্টির ঘাটও ঝুঁকিপূর্ণ। এখান থেকে মালামাল নিয়ে ওঠানো-নামানো করতে গিয়ে শ্রমিকেরা প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হন। প্রাণহানিও ঘটেছে কয়েকবার।
এ অবস্থা কাটাতে পুরান বাজারের ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রধান দাবি, বাজারটিকে মেঘনা-ডাকাতিয়ার ভাঙন থেকে রক্ষা করতে চারপাশে স্থায়ী ও মজবুত বাঁধ দিতে হবে। তাঁরা বলেন, এর সঙ্গে বাজারের ঘাট, সড়ক ও ড্রেনেজ-ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজালে এখানকার বাণিজ্যিক কার্যক্রম গতিশীল হওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীরাও আবার আকৃষ্ট হবেন। ফিরে আসবে চাঁদপুর নদীবন্দরের হারানো গৌরবও।
চাঁদপুর চেম্বারের সহসভাপতি তমাল কুমার ঘোষ বলেন, সম্প্রতি বাজারের মাঝামাঝি বাদিয়াবাড়ি খালের ওপর একটি প্রশস্ত সড়ক হওয়ায় পূর্ব অংশের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে পশ্চিম অংশের যে পরিস্থিতি, তা থেকে উত্তরণের জন্য সড়কগুলো সংস্কার ও ঘাটগুলো জরুরি ভিত্তিতে পুনর্নির্মাণ করতে হবে। বাদিয়াবাড়ি সড়কের মাথায় ও বাজারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পন্টুনের ব্যবস্থা করতে হবে।
চাঁদপুর লঞ্চঘাটের সংস্কারকাজ শেষে সেখানকার দুটি পন্টুন পুরান বাজারে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন চাঁদপুর নদীবন্দরের উপপরিচালক মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, লঞ্চঘাটের সংস্কারকাজ শিগগির শুরু হবে।
চাঁদপুর নদীভাঙন প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটির দক্ষিণাঞ্চলের সম্পাদক মুজিবুর রহমানের মতে, মেঘনার ভাঙনরোধে এ পর্যন্ত যত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তার কোনোটিরই সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নে সীমাহীন দুর্নীতির কারণেই পুরান বাজারের এই দুর্গতি।
পুরান বাজারের এই অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র নাছিরউদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যেই পুরান বাজারের সড়ক ও ঘাট পুনর্নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা হবে।
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, মেঘনার পার বাঁধাইয়ের একটি প্রকল্প চলমান। এটি আরও সম্প্রসারণ করা হবে। আর ডাকাতিয়ার দুই পার বাঁধাইয়ের জন্য এক সপ্তাহের মধ্যে করণীয় নির্ধারণের পরিকল্পনা রয়েছে।