চাঁদাবাজি কমলে দামও কমবে

যেভাবে সরকারি টোল আদায় হয়, সেভাবেই সড়ক ও বাজারে গুপ্ত চাঁদাবাজি হচ্ছে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।

ছবি: ম্যাগডা এহলারস, পেকজেলসডটকম

সড়ক-মহাসড়কে পুলিশ ও কাঁচাবাজারে প্রভাবশালীদের ‘গুপ্ত’ চাঁদাবাজিকে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলেছেন, সড়ক ও মহাসড়কে প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি হচ্ছে। বিষয়টি অনেকটা সরকারিভাবে টোল সংগ্রহের মতো হয়ে গেছে। চাঁদাবাজি কমলে নিত্যপণ্যের দামও কমবে।

নিত্যপণ্যের মজুত, আমদানি, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতিবিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় গতকাল শনিবার এসব কথা বলেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) ঢাকার মতিঝিলে নিজেদের কার্যালয়ে এ সভার আয়োজন করে।

গুপ্ত চাঁদাবাজির অভিযোগ না করে ব্যবসায়ীরা যদি সুনির্দিষ্ট তথ্য দেন, তাহলে আমরা জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এ বিষয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) কামরুজ্জামান

সভায় চাঁদাবাজির প্রসঙ্গটি প্রথম উত্থাপন করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিনিধি কাজী আবদুল হান্নান। তিনি বলেন, সরবরাহে কোনো ঘাটতি না থাকলেও খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ার অন্যতম কারণ চাঁদাবাজি। এতে প্রতিটি পণ্যের দামের একটি অংশ যায় চাঁদার পেছনে। এসব যদি সামাল দেওয়া না যায়, ভোক্তা পর্যায়ে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।

আরও পড়ুন

ক্যাবের এই প্রতিনিধি যখন সড়কে ও বাজারে চাঁদাবাজির কথা বলছিলেন, তখন সভায় উপস্থিত অধিকাংশ ব্যবসায়ী হাততালি দিয়ে তাঁকে সমর্থন জানান। একই সঙ্গে গুপ্ত চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে বলে কেউ কেউ স্লোগান দেন।

মতবিনিময় সভায় অনলাইনে যুক্ত ছিলেন রংপুর চেম্বারের সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী। তিনি বলেন, রংপুর থেকে রাজধানীতে পণ্য পাঠাতে পথে পথে পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। এটি বন্ধ করতে হবে।

সড়কে পণ্যবাহী যানবাহনে চাঁদাবাজি নিয়ে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন। তবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলেই তাঁরা মনে করেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুপ্ত চাঁদাবাজির অভিযোগ না করে ব্যবসায়ীরা যদি সুনির্দিষ্ট তথ্য দেন, তাহলে আমরা জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এ বিষয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দু-একজন যে এ ধরনের অপরাধে জড়িত নয়, সেটা আমরা বলব না। তবে গড়পড়তা অভিযোগ সঠিক নয়।’

এদিকে সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনেও পুলিশের চাঁদাবাজির এই চিত্র উঠে এসেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এক অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে জানায়, দেশের কৃষকেরা যে বাঁধাকপি গড়ে সাড়ে ১৩ টাকা দরে বিক্রি করেন, সেই বাঁধাকপিটি ঢাকায় এসে খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৩৮ টাকায়। এই দর কৃষক পর্যায়ে বিক্রি হওয়া দামের প্রায় তিন গুণ। শুধু বাঁধাকপি নয়, এভাবে বেগুন, শিম, ফুলকপি ও কাঁচা মরিচ কৃষক পর্যায়ের দামের দুই থেকে তিন গুণ দরে বিক্রি হয় ঢাকার বাজারে। এর কারণ মধ্যস্বত্বভোগী, পরিবহন খরচ ও পুলিশের চাঁদাবাজি।

গত ১ থেকে ৩ জানুয়ারি ঢাকার কারওয়ান বাজার, বগুড়া, যশোর, রাজশাহী ও মেহেরপুর জেলার কৃষক, ফড়িয়া, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা রাজশাহীর ব্যবসায়ীদের তথ্যানুযায়ী, জেলাটির বানেশ্বর বাজার থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজার পর্যন্ত পণ্য পরিবহনে ট্রাকভাড়া ১৭ হাজার টাকা। তবে রাজশাহীর আমচত্বর, বেলপুকুরিয়া, নাটোর বাইপাস, এলেঙ্গা বাইপাস, টাঙ্গাইল বাইপাস, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় দেড় হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। যশোর থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ট্রাকভাড়া ২৪ হাজার টাকা। এই পথেও কয়েক জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। প্রতিবেদনে ‘রাস্তা খরচ’ খাতে পুলিশের চাঁদার কথা বলা হয়েছে।

এফবিসিসিআইয়ের মতবিনিময় সভায় চাঁদাবাজি নিয়ে ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের একপর্যায়ে সভার সঞ্চালকের দায়িত্ব পালনকারী সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এগুলো নিয়ে ব্যবসায়ীরা উদ্বেগের মধ্যে আছেন। দ্রুত পুলিশ প্রধানকে নিয়ে একটা সভার ব্যবস্থা করব।’ তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের অভিমত তিনি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে জানানোর ব্যবস্থা করবেন।

রাজশাহীর ব্যবসায়ীদের তথ্যানুযায়ী, জেলাটির বানেশ্বর বাজার থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজার পর্যন্ত পণ্য পরিবহনে ট্রাকভাড়া ১৭ হাজার টাকা। তবে রাজশাহীর আমচত্বর, বেলপুকুরিয়া, নাটোর বাইপাস, এলেঙ্গা বাইপাস, টাঙ্গাইল বাইপাস, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় দেড় হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। যশোর থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ট্রাকভাড়া ২৪ হাজার টাকা। এই পথেও কয়েক জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। প্রতিবেদনে ‘রাস্তা খরচ’ খাতে পুলিশের চাঁদার কথা বলা হয়েছে।

রাতে জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পাইকারি ও খুচরা বাজারে দামের পার্থক্যের অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি চাঁদাবাজি। সদিচ্ছা থাকলে চাঁদাবাজি পুরোপুরি বন্ধ না হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব। সদিচ্ছা কার থাকা দরকার জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। তবে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের সদিচ্ছা দরকার।

বাজার তদারকিতে কমিটি

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই প্রতিবছরই রমজান মাস উপলক্ষে দ্রব্যমূল্য ও পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে সভার আয়োজন করে। এ বছর পরিস্থিতি ভিন্ন; কারণ, নিত্যপণ্যের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকের পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে একটু কম দামে পণ্য কিনছে মানুষ। রাজনৈতিক দলগুলো নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে কর্মসূচি পালন করছে। গতকালই বিএনপি ঢাকায় প্রতীকী গণ-অনশন কর্মসূচি পালন করে।

এফবিসিসিআইয়ের মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়া কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত ও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকায় পবিত্র রমজান মাসে চাল, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, ছোলা, চিনি, খেজুরের দাম বাড়বে না। তবে অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে সুযোগ না নিতে পারেন, এ জন্য এফবিসিসিআইকে নিয়মিত বাজার তদারকির পরামর্শ দেন তাঁরা।

এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জানান, রোজায় বাজার পরিস্থিতি নজরদারিতে এফবিসিসিআই ৪৬ সদস্যের বাজার তদারকি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কি না, তা তদারকি করবে। তিনি আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের ঋণখেলাপি না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমদানি করা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীদের প্রাপ্ত ঋণসীমা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদ্যমান চলতি মূলধনের ঋণসীমা অন্তত ৪০ শতাংশ বাড়ানো দরকার।

সরকারকে কর ও শুল্কহার সমন্বয়ের দাবি জানিয়ে জসিম উদ্দিন আরও বলেন, যেহেতু পণ্যের দাম বেড়েছে, তাই শুল্ক ও করহার কমালেও সরকারের রাজস্বের ঘাটতি হবে না। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়া যাবে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী, সাবেক সহসভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন, পরিচালক রেজাউল করিম, হারুন অর রশীদ প্রমুখ।

সুলভ মূল্যে দুধ-ডিম-মাংস বিক্রি

এদিকে রমজান উপলক্ষে রাজধানীর ১০ জায়গায় গাড়িতে করে সুলভ মূল্যে দুধ, ডিম ও মাংস বিক্রি করবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। আজ রোববার এ বিক্রি কার্যক্রম শুরু হবে। চলবে ২৮ রমজান পর্যন্ত। গতকাল মন্ত্রণালয়টির এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষি খামার সড়কের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রাঙ্গণে আজ সকালে এক অনুষ্ঠানে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।

প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত স্থানগুলো হলো সচিবালয়সংলগ্ন আবদুল গণি রোড, খামারবাড়ি গোলচত্বর, জাপান গার্ডেন সিটি, মিরপুর ৬০ ফুট রাস্তা, আজিমপুর মাতৃসদন, পুরান ঢাকার নয়াবাজার, আরামবাগ, নতুন বাজার, মিরপুরের কালশী ও যাত্রাবাড়ী। প্রতিটি গাড়িতে পাস্তুরিত তরল দুধ প্রতি লিটার ৬০ টাকা, গরুর মাংস প্রতি কেজি ৫৫০, খাসির মাংস প্রতি কেজি ৮০০, ব্রয়লার মুরগি (ড্রেসড) প্রতি কেজি ২০০ ও ডিম প্রতি হালি ৩০ টাকায় বিক্রি করা হবে।

দাম বেড়েছে বেগুন-শসার

রোজা শুরুর আগের দিন গতকাল ঢাকার বাজারগুলোতে ক্রেতার ভিড় বেশি ছিল। দাম আরও বেড়েছে। কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কেজি প্রতি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে, যা কয়েক দিন আগেও ৩০ থেকে ৪০ টাকা ছিল। একইভাবে ৪০ টাকা কেজির শসা ৮০ টাকা হয়েছে।

কারওয়ান বাজারে ধনেপাতা প্রতি কেজি ১৬০ থেকে ২০০ টাকা, টমেটো ৩০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৮০ থেকে ১০০ টাকা, ছোলা ৭০ থেকে ৭৫ টাকা, চিনি ৭৮ টাকা, গরুর মাংস ৬৫০ টাকা, ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি হালি ৩৩ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা যায়। অবশ্য অন্য বাজারে দাম আরও বেশি। যেমন ঢাকার শেওড়াপাড়ায় গতকাল গরুর মাংস প্রতি কেজি ৭০০ টাকা চান ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তিন বছর ধরে রমজান মাস উপলক্ষে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করা হয় না। গরুর হাটে গরুপ্রতি খাজনা ১০০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও ইজারাদার ইচ্ছেমতো আদায় করেন। তাঁর মতে, মাংসের দাম নিয়ন্ত্রণে উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নির্ধারিত হারে খাজনা আদায় ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।