চাঁদের আলোয় চাঁদপুর

আসলেই তো সুপারমুন! বুড়িগঙ্গার কালচে জলও তার আলোয় ঝকঝকে। এই রাতে কি আর ঘরে বসে থাকা যায়? ১৪ নভেম্বর বিকেলে পরিকল্পনা করে তাই রাতেই রওনা হই। এত কম সময়েও সঙ্গী হলো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একঝাঁক তরুণ ছেলেমেয়ে। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা বাজলেও বাইরে তখন দুধসাদা জ্যোৎস্না।

আমাদের পরিকল্পনা সদরঘাট থেকে লঞ্চে চাঁদপুর পর্যন্ত যাওয়া—নেমে ঘণ্টা খানেক ঘুরে আবার ঢাকায় ফিরে আসা। আর যাওয়া-আসার পুরো রাতটা সবাই মিলে ঝকঝকে চাঁদকে দুচোখ ভরে উপভোগ করা। লঞ্চের ছাদে পাটি বিছিয়ে বসেছি আমরা। তরতর করে লঞ্চ চলছে বুড়িগঙ্গার রুপালি জল কেটে। এর মধ্যে কেউ একজন গেয়ে উঠল, আজ ‘জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’। এই শুরু হলো সুপারমুন উদ্যাপন। পরের তিন ঘণ্টা কেটে গেল আড্ডা আর সুরে। চোখে পড়ল ছোট-বড় আরও অনেক তরুণ দলবেঁধে এসেছে চাঁদের আলো উপভোগ করতে। প্রস্তুতি অন্যদেরও কম নয়—গিটার, ইউকেলেলে, খঞ্জনিসহ নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে দলে দলে যেন অলিখিত গানের প্রতিযোগিতার আসর বসেছে। ছাদে ঠান্ডা বাতাস, সেই ঠান্ডা অল্প সময়েই গরম হয়ে গেল তারুণ্যের কাছে। গরম পোশাক পরে, গরম চায়ে চুমুক দিয়ে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কেউ কেউ। মেঘনা নদী দিয়ে ততক্ষণে লঞ্চ এসে ভিড়েছে চাঁদপুরে। রাত তখন প্রায় চারটা।

ঘাটে নেমে পরের লঞ্চের অপেক্ষা। এর মধ্যে একজন তথ্য নিয়ে এলেন, রাতের শেষ লঞ্চ ছেড়ে গেছে পাঁচ মিনিট আগে। পরের লঞ্চ ভোর ছয়টায়। অনেকেরই ঢাকা ফেরার তাড়া অফিস বা ক্লাসের জন্য। তবে যেহেতু দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই, তাই পরিকল্পনা সাজানো হলো নতুন করে। লঞ্চঘাট থেকে মিনিট দশেকের হাঁটাপথ মোহনা। মোহনা মানে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল। এখানে বসে আরও কিছুটা সময় কাটানো যাবে চাঁদের আলোয়। জনপ্রতি পাঁচ টাকা ভাড়ায় অটোতে উঠে মোহনায় (শহরের মাথা হিসেবেও এর পরিচিতি আছে) এসে নামলাম। এবার নদীর পাড়ে বসে আরও নতুনভাবে সুপারমুনকে আবিষ্কার।

গাছপালায় ঘেরা এই জায়গাটায় নদীর পাড় ঘেঁষে বানানো সিমেন্টের বেঞ্চে বসার ব্যবস্থা আছে। আমাদের আগেই আরও কয়েকটি দল সেখানে বসে আছে চাঁদের দিকে মুখ করে। আমরাও বসে গেলাম। কেউ কেউ মুঠোফোনে চাঁদের সঙ্গে সেলফি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। জ্যোৎস্নার আলোতে সেখানে চোখে পড়ল রক্তধারা নামে একটি ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অনেক সাধারণ মানুষকে মেরে এই মোহনায় ফেলে দেওয়া হয়। তাঁদের সম্মানে তিন ফোঁটা রক্তের আদলে তৈরি এই শহীদবেদি। দেড় ঘণ্টা পর সেখান থেকে আবার লঞ্চঘাটে এসে সোজা সবাই খাবার দোকানে। চাঁদপুরে এসে কি ইলিশ না খেলে মুখ থাকবে! অগত্যা সবাই কবজি ডুবালো ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত, আলুভর্তা আর চাঁদপুরের ভাজা ইলিশে। খেতে বসতেই লঞ্চের হর্ন। নাকেমুখে খাওয়া শেষ করে লঞ্চে ওঠা। ভোরের আলো ফুটছে আর রাতের ঝকঝকে চাঁদ তার রূপ বদলাচ্ছে। দিনের আলো নিয়ে সূর্য উঁকি দিতেই সুপারমুন মিলিয়ে গেল ১৮ বছরের জন্য।