চাকরিচ্যুতির পেছনে পর্দার আড়ালের শক্তি কাজ করেছে

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সদ্য চাকরিচ্যুত আলোচিত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কক্সবাজারে সরকারের প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানের কাজটি কীভাবে শুরু হলো?

শরীফ উদ্দিন: দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় র‌্যাবের একটি দল কক্সবাজারে সরকারি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির টাকা এবং সরকারি নথিসহ দুজন সার্ভেয়ারকে আটক করে। ওই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দুদক থেকে আমাকে দেওয়া হয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি কারা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে ভূমি কার্যালয়ের বেশির ভাগ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও একটি দালাল চক্র এ দুর্নীতিগুলো করত। সেখানকার যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে তারা নানা তথ্য দিত। আমি এসব দুর্নীতির তথ্য–প্রমাণ সংগ্রহ করি, প্রতিবেদন তৈরি করি। সে সময় দুদকের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে আসা কর্মকর্তারা আমার তদন্ত, মামলা এবং অভিযানের প্রশংসা করেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কক্সবাজারে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিয়ে নানা অভিযোগও উঠেছে?

শরীফ উদ্দিন: আপনি জানেন, দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে কক্সবাজার-টেকনাফে আর্থসামাজিক অবস্থা ভিন্ন। সেখানে ইয়াবা, মানব পাচার, চোরাচালান থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপরাধমূলক তৎপরতা বেশি। সেখানে আবার সরকার অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আর ভূমি নিয়ে সেখানে অনেক আগে থেকে একটি টাউট বা দালাল চক্র সক্রিয় ছিল। ফলে অভিযানের সময় আমি অনেককে আটক করি, জিজ্ঞাসাবাদ করি। এসব কারণে এলাকার দুর্নীতিবাজ ও অপরাধ চক্রের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। অনেকে আমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালায়। এমন কথাও শুনতে পেলাম, আমার নাম করেও অনেক দালাল চাঁদাবাজি করছে। আমি তখন বলেছিলাম, যদি এমন কোনো কথা আপনারা শোনেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ধরে নিয়ে আসবেন। এমনকি আমার পরিবারের পরিচয় দিলেও ধরে আনবেন। কিন্তু কেউ তা করেনি। মূলত আমার অভিযানের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল তারা এসব অপপ্রচার চালিয়েছে।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনার বিরুদ্ধে তো অনেকে দুদকেও অভিযোগ করেছে।

শরীফ উদ্দিন: আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন, যারা আমার বিষয়ে অভিযোগ করেছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে আমি দুর্নীতির তদন্ত করেছি। যেমন কক্সবাজারে ইদ্রিসের (সিআইপি হিসেবে পরিচিত) বিরুদ্ধে দুদকের পাঁচটি তদন্ত চলছে। বেলায়েত হোসেন নামেও একজন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। যারা এখন পর্যন্ত জবানবন্দি দিয়েছে, তারা কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রতিদিনের মেডিকেল সার্টিফিকেট তাদের পরিবারকে দেওয়া হতো। সেখানে কেউ প্রমাণ করতে পারবে না শারীরিকভাবে নির্যাতন করে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা আবার দুদক কার্যালয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে। দুঃখজনক হচ্ছে দুদকের কার্যালয় থেকে সেগুলো আমলে নিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: তদন্তের সময় আপনি কয়েকজন অভিযুক্তের ব্যাংক হিসাবের টাকা জব্দ করেছেন, এ প্রসঙ্গে কী বলবেন।

শরীফ উদ্দিন: কক্সবাজার পানি পরিশোধনাগার প্রকল্পের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কয়েকজনের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান প্রভাব সৃষ্টি করেছেন। যে জায়গায় ওই প্রকল্প করা হচ্ছে, সেখানে মেয়রের স্ত্রী এবং শ্যালকের নামে আগেভাগে জমি কিনে রাখা হয়েছে। তা বেশি দামে সরকারের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। বিকল্প জায়গায় এটি করলে সরকারের কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা কম খরচ হতো।

তদন্তের মাধ্যমে এ দুর্নীতি বের করার পর আমি মেয়রের শ্যালক মিজানুর রহমানের ব্যাংক হিসাবে থাকা পাঁচ কোটি টাকা উত্তোলন বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে অনুরোধ করে চিঠি দেই। আমি কোনো আদেশ তো দিইনি, সেটা দেওয়ার আমার এখতিয়ারও নেই। তদন্তের স্বার্থে সীমিত সময়ের জন্য আমি ওই অনুরোধ করেছিলাম। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমার অনুরোধ রাখতেও পারেন, না–ও পারেন। এ ক্ষেত্রে আমার উদ্দশ্য ছিল যাতে মিজানুর রহমান ওই দুর্নীতির টাকা উত্তোলন করে নিতে না পারেন। রাষ্ট্রের সম্পদ যাতে রক্ষা পায়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি দুদকের নির্দেশ মেনে এসব তদন্ত করছিলেন, তাহলে আপনাকে চাকরিচ্যুত কেন করা হলো?

শরীফ উদ্দিন: আমি যেসব ঘটনার তদন্ত করেছি, তাতে অনেক প্রভাবশালী চক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কক্সবাজারের ভূমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে কর্ণফুলী গ্যাস, চট্টগ্রামে হাসপাতাল ও চিকিৎসাব্যবস্থা এবং রোহিঙ্গা নিয়ে যারা দুর্নীতি করে অর্থ উপার্জন করছিল, তারা আমাকে অনেকভাবে হুমকি ও প্রলোভন দিচ্ছিল। কানাডায় বাড়ি কিনে দেবে, নগদ কোটি টাকা দেবে, এমন সব প্রলোভনের পরেও আমি কাউকে ছাড় দিইনি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছি, তাদের নাম তদন্ত প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করেছি। এই সবগুলো প্রকল্পের সুবিধাভোগী দুর্নীতিবাজ চক্র একত্র হয়ে হয়তো দুদককে প্রভাবিত করেছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ওই চক্র কারা বলে মনে করেন?

শরীফ উদ্দিন: যাদের নাম তালিকায় এসেছে, তাদের পেছনে অনেক প্রভাবশালী মদদদাতা আছে। যারা পর্দার অন্তরালে কাজ করছে। আমার অভিযান এবং তদন্তের ফলে তাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। অনেকের মুখোশ উন্মোচন হতে পারে বলে তারা মনে করছে। যে কারণে তারা সবাই একজোট হয়ে আমার চাকরিচ্যুতির জন্য চেষ্টা করেছে। দুদক থেকে আমাকে চাকরিচ্যুতির আগেই তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব কথা লিখেছে। আমাকে লাল দালানের ভাত খাওয়াবে মানে জেলখানায় ভরবে। ফলে পুরো বিষয়টি পরিকল্পিতভাবে তারা করেছে। আমাকে বাসায় এসে হুমকি দিয়ে গেছে। আমি এটা দুদক কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারা আমার নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো চাকরিচ্যুত করল। চাকরিচ্যুতির পেছনে পর্দার আড়ালের শক্তি কাজ করেছে।

আমি শুরু থেকে দুদকের শীর্ষ পর্যায় থেকে দুর্নীতির তদন্তের ব্যাপারে সহযোগিতা পেয়েছি। কক্সবাজারের তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগে আমাকে দুদক থেকে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নে ‘অতি উত্তম কর্মকর্তা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর আমার ব্যাপারে তাদের মনোভাব বদলে গেছে। ফলে আমার এখনো বিশ্বাস, দুদক কর্তৃপক্ষ আমার বিষয়টি সদয়ের সঙ্গে বিবেচনা করবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি এখন কী চান, কী করবেন?

শরীফ উদ্দিন: আমি দুদকের কাছে আমার পদচ্যুতির সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য আবেদন করব, প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে যাব। আমি দেশের দুর্নীতি দমনের জন্য কাজ করতে চাই। সরকারের প্রকল্পগুলো সফল হোক, সেই লক্ষ্যে দুর্নীতির বাধাগুলো চিহ্নিত করেছি, যাতে প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়। সামনের দিনগুলোতে দুদকের সেই কাজে এবং দেশের জন্য আমি কাজ করতে চাই। আশা করি দুদক এবং সরকার আমাকে সেই সুযোগ দেবে।