চাল, আটা, ডাল, তেলে ব্যয় বেড়েছে ৪০%

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে এক দিনের খাবারের জন্য ছয়টি নিত্যপণ্য কিনতে ব্যয় ছিল ২২ দশমিক ৮৬ টাকা, এখন ৩২ টাকা।

চাল, ডাল, তেল ও আটার ব্যয় বেড়েছেছবি: সংগৃহীত

একজন শ্রমজীবী মানুষের এক দিনের খাবারের জন্য প্রয়োজনমতো চাল, আটা, ডাল, তেল, আলু ও চিনি কিনতে বছর তিনেক আগে যে ব্যয় হতো, এখন তার চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি খরচ হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ২০২১ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, উচ্চমাত্রায় সক্রিয় একজন মানুষের খাদ্যতালিকায় দৈনিক ৩৩৩ গ্রাম চাল, ৩৯ গ্রাম আটা, ৫০ গ্রাম আলু, ৬০ গ্রাম ডাল, ৪৫ গ্রাম ভোজ্যতেল ও ২৫ গ্রাম চিনি দরকার।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারির বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, তখন একজন শ্রমিকের এক দিনের খাদ্যের জন্য এসব পণ্য পরিমাণমতো কিনতে ব্যয় হতো ২৩ টাকার কিছু কম। এখন হয় ৩২ টাকার বেশি।

এই জরিপে শ্রমিকের খাদ্যতালিকায় এসব পণ্য ছাড়াও বীজজাতীয় খাদ্য, শাক, কলা, মাছ, দুধ ও কাঁঠালের বিচি রয়েছে। সব মিলিয়ে তালিকায় ১৪টি পণ্য রয়েছে, যা ২ হাজার ৩০০ ক্যালরি খাদ্যশক্তির সমান।

জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে জরিপকালে একজন শ্রমজীবীর এক দিনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম ছিল ১২৪ টাকা। মাঝারি মাত্রায় সক্রিয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যয় ছিল ৬৮ টাকা আর কম সক্রিয় মানুষের ক্ষেত্রে ব্যয় দেখানো হয়েছিল ৫৬ টাকার কিছু বেশি। শিশুদের বয়সভেদে ৩৩ থেকে ১২১ টাকার খাদ্যের দরকার ছিল ২০২১ সালে।

খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে ও আয় না বাড়লে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া কমিয়ে দেন দরিদ্র মানুষেরা। তাঁরা ডাল, ভাত, আলু ও সবজি খেয়ে কোনোমতে জীবন যাপন করেন।
নাজমা শাহীন, অধ্যাপক, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে ও আয় না বাড়লে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া কমিয়ে দেন দরিদ্র মানুষেরা। তাঁরা ডাল, ভাত, আলু ও সবজি খেয়ে কোনোমতে জীবন যাপন করেন।

সব মিলিয়ে দেখা যায়, পাঁচ সদস্যের একটি গড়পড়তা পরিবারে ২০২১ সালে খাদ্যের ব্যয় ছিল দিনে প্রায় ৪০০ টাকা। খাদ্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, আটা, ডাল, ভোজ্যতেল, শাকসবজি, মাছ, কম দামি ফল, ডিম, দুধ ইত্যাদি। বাংলাদেশে সহজে পাওয়া যায় এবং দাম কম, এমন খাদ্য ওই তালিকায় রাখা হয়েছে।

চাল, ডাল, ডিম, পেঁয়াজ, তেল, আলু
ছবি: সংগৃহীত

বাজারে সাম্প্রতিক কালে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা দলের প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে ও আয় না বাড়লে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া কমিয়ে দেন দরিদ্র মানুষেরা। তাঁরা ডাল, ভাত, আলু ও সবজি খেয়ে কোনোমতে জীবন যাপন করেন। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুষ্টিকর খাবারগুলোর দাম কিছুটা বেশি থাকে।

পাতে কমেছে মাছ-মাংস

সীমিত আয়ের মানুষ তাঁদের খাবারের পাত থেকে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম কমিয়ে এখন বাড়তি ব্যয় সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নিম্নবিত্তের বাস, এমন জায়গায় মাছ, মাংস বিক্রি কমেছে।

যেমন তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ীর মূল সড়কের পাশে ছোট একটি বাজার। বাজারটিতে ভ্যানগাড়িতে গরুর মাংস নিয়ে অলস সময় কাটাচ্ছিলেন বিক্রেতা মো. মামুন। দোকানটির সামনে মাংসের দাম জিজ্ঞাসা করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন ক্রেতা শহিদুল ইসলাম, যিনি তেজগাঁওয়ে কাপড় বিক্রি করে সংসার চালান। দাম শুনে আর মাংস কেনেননি।

এমন সময় গিয়ে মাংস বিক্রেতা মামুনের কাছে বেচাকেনা কেমন, জানতে চাইলে তিনি একরাশ বিরক্তি নিয়ে শুকিয়ে যাওয়া গরুর মাংস থেকে মাছির দল তাড়াতে তাড়াতে বললেন, ‘দাম ৭০০ টাকা কেজি থেকে ৬৮০ করে দিয়েছি। তা-ও বিক্রি হচ্ছে না।’ তিনি আরও জানান, মাস দুয়েক আগেও দিনে তিনি গড়ে ১০০ কেজি মাংস বিক্রি করতে পারতেন। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনে ৫০ কেজিও বিক্রি হয়নি। সাধারণত শুক্রবার অন্য দিনের চেয়ে বেশি মাংস বিক্রি হয়।

‘দেশের গরিব মানুষদের কম দামে খাদ্য নিশ্চিত করতে আমরা বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় গম আনা নিশ্চিত করেছি। চলতি মাসের মধ্যে আরও তিন লাখ টন গম দেশে আসছে।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে গম আমদানি নিয়ে আলোচনা চলছে, বিকল্প হিসেবে আমরা আরও কয়েকটি দেশ থেকে গম আনার চেষ্টা করছি।’
মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব

বাজারটিতে ভ্যানগাড়িতে নানা পদের ডাল, আদা, রসুন আর পেঁয়াজ নিয়ে বসে ছিলেন আরেক বিক্রেতা আনু মিয়া। সেখানে জনা তিনেক ক্রেতা হাজির। কেউ ১০০ বা ২০০ গ্রাম ডাল আর আধা কেজি অথবা এক কেজি আলু কিনছেন। বেচাকেনা কেমন, এই প্রশ্ন করতেই ক্রেতা-বিক্রেতার দিক থেকে জোরালো প্রতিক্রিয়া এল।

তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক আসমা খাতুন কিছুটা খেপে গিয়ে বললেন, ‘এত দিন বাজারে আসতাম পছন্দমতো জিনিস কিনতে। এখন ১০০-১৫০ টাকায় যা পাওয়া যায়, তা-ই কিনি। ভাত, ডাল, সবজি ছাড়া আর কোনো কিছু রান্না করা বন্ধ করে দিছি।’ তিনি বলেন, পরিবার নিয়ে এই শহরে টেকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেসব মানুষ বেশি বিপাকে পড়েছেন, যাঁদের আয় নির্দিষ্ট। চাইলেই বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই।

রাজধানীর কাজীপাড়া থেকে শুরু করে মিরপুর ১১ নম্বর সেকশন পর্যন্ত আরও তিনটি বাজার ও নাখালপাড়া ঘুরে একই চিত্র দেখা গেল। দোকানে ক্রেতা কম। মাছ-মাংসের দোকানে ক্রেতা আরও কম। আগে যাঁরা কেজি দরে সবজি আর তেল, ডাল, পেঁয়াজ কিনতেন, তাঁরা এখন ২৫০ থেকে ৫০০ গ্রামের বেশি কিনছেন না। ওদিকে বিক্রেতারা জানালেন, দাম নিয়ে দোকানিদের সঙ্গে দর-কষাকষি বেড়ে গেছে।

ঢাকার এই নিম্ন আয়ের মানুষেরা জানালেন, তাঁদের কারও কারও বাজারের ব্যয় মাসে এক হাজার টাকা, কারও দেড় হাজার টাকা, আবার কারও বেড়েছে দুই হাজার টাকা। এটা তাঁদের মোট আয়ের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ ক্রেতা মাছ, মাংস, তেল, দুধ, ডিম ও সবজির মতো পুষ্টিকর খাবার কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।

দাম কতটুকু বাড়ল

বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয়েছে করোনাকালের শুরুতে। তবে সাম্প্রতিক কালে সবকিছুর দাম বাড়ছে। এর কারণ বিশ্বব্যাপী সরবরাহ বিঘ্নিত, দাম বেড়ে যাওয়া ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি।

টিসিবির ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ও গতকাল শুক্রবারের বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তখন মোটা চালের কেজি ছিল ৪০ টাকা, এখন সর্বনিম্ন ৪৫ টাকা; অ্যাংকর ডালের সর্বনিম্ন দাম ছিল ৩৫ টাকা, এখন ৫৫ টাকা; আটা ছিল ২৭ টাকা, এখন ৪৬ টাকা; সয়াবিন তেলের লিটার ছিল ১০০ টাকা, এখন ১৯৮ টাকা। শুধু আলুর দাম তখনকার তুলনায় সামান্য কম।

আগামী দিনগুলোতে নিত্যপণ্যের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, বিশ্ববাজারে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গমের সরবরাহ কার্যত বন্ধ। ভারতও গম রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ১৯ মের দৈনিক খাদ্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন বলছে, সরকারি গুদামে চালের মজুত এখনো ১০ লাখ টনের কিছুটা বেশি থাকলেও গমের মজুত কমে আসছে। সরকারি গুদামগুলোতে এখন প্রায় এক লাখ টন গম রয়েছে। ভারত গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে গমের দামও দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে। গত এক মাসে গমের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ভরা মৌসুমে বেড়েছে চালের দাম।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের গরিব মানুষদের কম দামে খাদ্য নিশ্চিত করতে আমরা বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় গম আনা নিশ্চিত করেছি। চলতি মাসের মধ্যে আরও তিন লাখ টন গম দেশে আসছে।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে গম আমদানি নিয়ে আলোচনা চলছে, বিকল্প হিসেবে আমরা আরও কয়েকটি দেশ থেকে গম আনার চেষ্টা করছি। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাও বাড়ানো হচ্ছে।’

‘দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার’

নিম্ন আয়ের একজন মানুষের আয়ের অর্ধেকের মতো ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। তাই খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি তাঁদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে।

অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত দ্রুত বাজারে পুষ্টিকর খাবারগুলোর দাম কমানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া। সরকারি সংস্থার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার তাঁদের কাছে কম দামে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। নয়তো দেশের বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ অপুষ্টিজনিত নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হবেন। এতে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের ক্ষতি হবে।