চা চাষে নতুন স্বপ্ন, বিপুল আশা

চায়ের চাষ হচ্ছে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীর গান্ধীগাঁও গ্রামে।  ছবি: সংগৃহীত
চায়ের চাষ হচ্ছে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীর গান্ধীগাঁও গ্রামে। ছবি: সংগৃহীত
>

• বড় কোনো বাগানে চা চাষ হয় না
• বাড়ির পাশে বা পতিত জমিতে চা হচ্ছে
• চা বোর্ডের লক্ষ্য ২০২০ সালে ১ কোটি কেজি চা ক্ষুদ্র খাত থেকে উৎপাদন করা

চা-বাগান শব্দটি শুনলে মানচিত্রে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট এলাকাকেই খুঁজবেন বেশির ভাগ মানুষ। সবুজের ঢেউখেলানো বিশাল বিশাল চায়ের বাগানের ছবিই হয়তো চোখে উঠবে ভেসে। বাংলাদেশে চা–চাষের খোঁজখবর যাঁরা বেশি রাখেন, তাঁরা দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের কথাও ভাবতে পারেন। কিন্তু গারো পাহাড়ের পাদদেশের শেরপুর বা ময়মনসিংহেও চায়ের আবাদ হচ্ছে, তা ভাবাটা একটু কঠিনই।

এখানে ‘আবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করা হলো। কারণ, এখন বিভিন্ন জেলায় যে ধরনের চা–চাষের প্রসার ঘটছে তা বড় কোনো বাগানে না। বাড়ির পাশে বা অনাবাদি, পতিত জমিতে সীমিত আকারে চলছে এর চাষাবাদ। চা–চাষের বিশেষজ্ঞরা একে বলেন, ক্ষুদ্র পরিসরে (স্মল হোল্ডিং) চায়ের আবাদ। ছোট আকারের জমির চাষের মালিকও ভিন্ন।

ক্ষুদ্র পরিসরে চা–চাষের পথিকৃৎ কিন্তু দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। ১৯৯৭ সালে এখানে চা–চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই করে ভালো ফল পায় চা বোর্ড। সেখানে বেসরকারি উদ্যোগে বড় বাগান হয়। ক্ষুদ্র পরিসরে চায়ের আবাদ বেশি জনপ্রিয় হতে থাকে। ছড়িয়ে পড়ে অন্য জেলায়ও।

যেমন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার আবুল হাশেম। উপজেলার ঘোগা ইউনিয়নের চারিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হাশেম সম্পন্ন কৃষক। ‘ভিন্ন ধরনের’ চাষের প্রতি দুর্বলতা ছিল তাঁর। দুই বছর আগে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে পঞ্চগড় যান। পতিত জমিতে চা–চাষ করে মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি দেখে এতে তিনিও আগ্রহী হন। গেল বছর নভেম্বরে নিজের ৪ শতাংশ জমিতে ২০০ চারা এনে চা–চাষ শুরু করেন। তিন ইঞ্চি লম্বা ছিল চারাগুলো। এখন প্রায় ১০ ইঞ্চি হয়ে গেছে। আবুল হাশেম বলছিলেন, ‘আমার খেত দেইখ্যা এখন অনেকেই আগ্রহী হইতেছে। এখানে যে চা–চাষ হইব, কেউ ভাবে নাই।’

হাশেমের খেতের চায়ের ফলন আশাতীত ভালো বলেই মনে করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ফাইজুল ইসলাম ভূঞা। বললেন, ‘হাশেম কারও সহযোগিতা ছাড়া ভালো চাষ করেছেন। এখন আমরা তাঁকে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছি।’

হাশেমের চাষে উদ্দীপ্ত উপজেলার দাওগাঁও ইউনিয়নের ইলিয়াস উদ্দিন। কমলাপুর গ্রামে পতিত জমিতে চায়ের চাষ করতেন তিনি। আবার ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ীর সাড়ে ৪ একর জমিতে ছোট আকারে চা–চাষ শুরু হয়েছে।

তবে এই এলাকার চা–চাষের পথিকৃৎ মো. আমজাদ হোসেন নামের এক উদ্যোক্তা। গারো হিলস টি কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান তিনি। চা বোর্ড সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে বাংলাদেশ টি বোর্ড গারো পাহাড়ের পাদদেশে অনুর্বর টিলায় চা–চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই করে এ অঞ্চলে চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে। তবে উদ্যোক্তা, জমি এবং অর্থায়নের অভাবে তখন সেখানে আর চা–চাষ হয়নি।

চা বোর্ডের এই গবেষণার কথা জানতেন আমজাদ হোসেন। তিনি প্রথমে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীতে গারো ও হাজং জাতিসত্তাঅধ্যুষিত এলাকায় এ চাষে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। ২০১৭ সালে ১৩ জন স্থানীয় কৃষককে তিনি পঞ্চগড়ে চা–চাষ দেখতে পাঠান। এরপর গত বছরের এপ্রিল মাসে তিন উপজেলার ২৬ জন কৃষক এ চাষ শুরু করেন। আমজাদ হোসেন বলেন, এখানে যেসব জমিতে চায়ের আবাদ হচ্ছে, এর মধ্যে ৯০ ভাগ আবাদই চমৎকার হয়েছে। এটা সত্যিই বিস্ময়কর।

চা–চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে এখন শতাধিক কৃষক আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে জানান আমজাদ হোসেন। তিনি দুই লাখ চারা দিয়ে একটি নার্সারি তৈরি করেছেন। আবার শেরপুর শহরে তৈরি করছেন প্রক্রিয়াজাত কারখানা।

এখন শেরপুরের তিন উপজেলায় ক্ষুদ্র চা চাষি উন্নয়ন কমিটি তৈরি করা হয়েছে। এর সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, এখন ২৬ জন্য সদস্য আছেন কমিটিতে। আরও ৯৮ জন নতুন সদস্য হতে চান।

ময়মনসিংহের চা–চাষে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্য নিয়েও চিন্তিত নন। চা–পাতা শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করার পরই তা পানের জন্য উপযুক্ত হয়। ময়মনসিংহ অঞ্চলের শেরপুরে এখন একটি কারখানা তৈরির কাজ চলছে।

ক্ষুদ্র আকারে চা–চাষ জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ এখান থেকে দ্রুত এবং স্থায়ী আয় হয়—এমনটাই মনে করেন চা–চাষ বিশেষজ্ঞ নাসিম আনোয়ার। পাতি সার্ভিস নামে একটি বেসরকারি চা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নাসিম আনোয়ার বলেন, এযাবৎ যেখানে ক্ষুদ্র আকারে চাষ হচ্ছে, কোথাও কেউ ক্ষতির মুখে পড়েনি। আর এ জন্যই এটি জনপ্রিয় হচ্ছে।

পঞ্চগড় সদরের তেঁতুলিয়া উপজেলার মাঝিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বললেন, ‘২০ শতক জমিতে চাষ করে ৪০ দিন পরপর ২০ থেকে ২২ হাজার টাকার চা–পাতা বেচি।’

কেন ক্ষুদ্র পরিসরে চা–চাষ
দেশের চা–চাষের দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা বোর্ড এই আবাদকে সাদরে গ্রহণ করছে। চা বোর্ডের উপপরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন দেশের ভবিষ্যৎ এই সীমিত আকারের চায়ের চাষে। কারণ, যে হারে চায়ের চাহিদা বাড়ছে তাতে এই ধারার চায়ের আবাদের বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ টি বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন চায়ের চাহিদার তুলনায় ভোগের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বাড়তি চায়ের জন্য আমদানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ২০১৪ সালে দেশে সাড়ে ৬ কোটি কেজির মতো চা উৎপাদিত হয়। বিপরীতে অভ্যন্তরীণ ভোগের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৭০ লাখ কেজির বেশি। ২০১৮ সালে দেশে ৮ কোটি ২১ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়। ভোগ ছিল ৯ কোটি কেজি। এর মধ্যে সাড়ে ৮০ লাখ কেজি চা আসে ক্ষুদ্র পরিসরের আবাদ থেকে। গত চার বছরে ৯ গুণের বেশি বেড়েছে ক্ষুদ্র পরিসরে চায়ের উৎপাদন।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের লক্ষ্য ২০২০ সালে ১ কোটি কেজি চা ক্ষুদ্র খাত থেকে উৎপাদন করা। আর ২০৩০ সালে তা হবে ৩ কোটি কেজি চা। ওই সময় দেশের মোট চা উৎপাদন হবে ১৪ কোটি কেজি এবং চাহিদা থাকবে ১৩ কোটি কেজি। এর মধ্যে ৩ কোটি কেজি আসবে ক্ষুদ্র পরিসর থেকে।

মুনির আহমেদ বলেন, ২০৩০ সালে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ক্ষুদ্র বাগান থেকে উৎপাদন করতে পারলে আর আমদানিনির্ভরতা থাকবে না। তখন বরং কিছু উদ্বৃত্ত থাকবে।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে প্রথাগত চা–বাগানের বাইরে প্রথম চা–চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৯৯ সালে, পঞ্চগড়ে। আর উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০২ সালে। এখন উত্তরের জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, শেরপুর ও ময়মনসিংহে ক্ষুদ্র আকারে চায়ের আবাদ হচ্ছে। এর পাশাপাশি আবাদ হচ্ছে পার্বত্য তিন জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটিতে। বান্দরবানে চা বোর্ডের নিবন্ধিত প্রায় ৩০০ একর জমিতে চায়ের আবাদ হচ্ছে। এখানে বিঘাপ্রতি ৫০০ কেজির বেশি চা উৎপাদন হচ্ছে
তবে চা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেবল ১০ জেলায় নয়, দেশের ২৫ জেলায় ক্ষুদ্র আকারে চায়ের আবাদ সম্ভব। এ ছাড়া সমতলে ক্ষুদ্র আকারে চায়ের আবাদে উৎপাদন ভালো। পাহাড়ে সেই তুলনায় কম। তবে সমতলের চেয়ে পাহাড়ের চায়ের মান ভালো।

চা বোর্ড এবং চা–বাগানসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চা–বাগানে দিন দিন শ্রমিক ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন শ্রমিকেরা। যদিও ক্ষুদ্র পরিসরে চা–চাষকে সরকারি স্তরে উৎসাহিত করার এটিও একটি কারণ। আকারে ক্ষুদ্র হলে পারিবারিক শ্রমে চাষ হবে। শ্রমিক ঘাটতির সমস্যায় পড়তে হবে না। আর উত্তরাঞ্চলের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, চা–চাষ করে দরিদ্র মানুষ তাঁদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করছেন। আগামী দিনে দারিদ্র্য কমাতেও এটি ভূমিকা রাখবে।

তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বুদ্ধজ্যোতি চাকমা (বান্দরবান) রাজিউর রহমান (পঞ্চগড়)