চিনিকল ঘিরে সংকট, দরকার আধুনিকায়ন

১৪ বছর ধরে টানা লোকসান

  • প্রতি কেজিতে উৎপাদন ব্যয় ১৫০ টাকা।

  • সরকার নির্ধারিত বিক্রয়মূল্য ৬০ টাকা।

  • বেসরকারি চিনির কেজি ৫৫ টাকা।

  • প্রায় ২০ কোটি টাকার চিনি অবিক্রীত।

পঞ্চগড় চিনিকল ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু দীর্ঘ লোকসানের কারণে চিনিকলটি বন্ধের আশঙ্কা করছেন আখচাষি, শ্রমিক ও কর্মচারীরা
ছবি: প্রথম আলো

পঞ্চগড়ের মানুষ আখকে বলে কুশার। সেই কুশার কাটার মৌসুম শুরু হতে আর মাস দু-এক বাকি। তবে কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে মাটি নরম হয়ে কুশারগাছ হেলে পড়েছে। ভরদুপুরে সেই হেলে পড়া গাছগুলো বেঁধে সোজা করে দিচ্ছিলেন শহিদুল ইসলাম (৪০)।

শহিদুলের বাড়ি বোদা উপজেলার ময়দানদীঘি ইউনিয়নের গাইঘাটা গ্রামে। বাড়িসংলগ্ন এক একর জমি ভাড়া (লিজ) নিয়ে আখ চাষ করেছেন। জেলার অন্য চাষিদের মতো তিনিও কুশার বিক্রি করবেন পঞ্চগড় চিনিকলে। পঞ্চগড় চিনিকল বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) অধীনে থাকা ১৫টি চিনিকলের একটি।

খেতে কাজ করার সময় শহিদুলের সঙ্গে কথা হয় গত ২৮ সেপ্টেম্বর। খেতের আখ নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। লোকমুখে শুনেছেন, লোকসানের কারণে পঞ্চগড় চিনিকলটি শিগগির বন্ধ হতে যেতে পারে। মিল বন্ধ হলে আখের কী হবে!

আখচাষি শহিদুলের মতো মিলে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীরাও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন। এই চিনিকল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন কয়েক হাজার মানুষ। উদ্বিগ্ন তাঁরাও।

জেলার একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান পঞ্চগড় চিনিকল। চিনিকল ছাড়াও এটির আওতাধীন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, হাফেজিয়া মাদ্রাসা, জেনারেল ক্লাব, ট্রেনিং কমপ্লেক্স ও অতিথি ভবন রয়েছে। মিল ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি বাজার। এসব নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

১ অক্টোবর শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন পঞ্চগড়ে এলে চিনিকলটি সচল রাখার দাবিতে তাঁকে স্মারকলিপি দেয় পঞ্চগড় চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়ন। এ প্রসঙ্গে পঞ্চগড় জেলা সার্কিট হাউসে শিল্পমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের অঙ্গীকার হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। কাজেই কোনো চিনিকল বন্ধ করা হবে না। তবে চিনিকলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা হবে।

চিনিকলগুলো বেসরকারীকরণ হবে কি না, এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে তিনি বলেছেন, চার-পাঁচটি চিনিকল জাতীয় চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। ফলে এত বড় সম্পদ ফেলে রাখা যাবে না। বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।

কেন দুশ্চিন্তা

পঞ্চগড় চিনিকলের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ১০ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড় চিনিকলসহ দেশের সব সরকারি চিনিকলকে জরুরি চিঠি দেয় খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। চিঠিতে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, লাভ-লোকসান ও শ্রমিক-কর্মচারীদের দেনা-পাওনার হিসাব চাওয়া হয়েছে।

পঞ্চগড় চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীরা বলছেন, বিএসএফআইসির চিঠির একটি অংশে চিনিকলের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের অবসরে পাঠালে কী পরিমাণ অর্থ লাগতে পারে তারও হিসাব চাওয়া হয়েছে। চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন পঞ্চগড় চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার। তিনি বলেন, করপোরেশনের চাহিদামতো সব তথ্য পাঠানো হয়েছে। কিন্তু করপোরেশন কেন এসব তথ্য চাইল তা তাঁর জানা নেই—বললেন রুহুল আমিন।

ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ইউসুফ আলী জানান, পঞ্চগড় চিনিকলে কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের অনুমোদিত পদ আছে ৯৯৪টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ২৮৯ জন। শূন্য পদগুলোর বিপরীতে ৫০১ জন শ্রমিক-কর্মচারী দৈনিক হাজিরা ও মৌসুমভিত্তিক চাকরি করছেন। একসময় চিনিকলটিতে দেড় হাজারের বেশি জনবল ছিল।

জেলা শহরের কাছেই ধাক্কামারা এলাকায় চিনিকলটির বাঁ পাশে দাপ্তরিক কার্যালয়। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বেলা একটার দিকে সেখানে গিয়ে দেখি, সুনসান নীরবতা। দাপ্তরিক কাজকর্ম চললেও কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপস্থিতি খুব কম। একজন কর্মকর্তা জানালেন, দাপ্তরিক কাজকর্ম শুরু হয় সকাল সাতটায়, চলে বেলা দুইটা পর্যন্ত।

কারখানার উত্তর গেটে দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মী মফিজুল ইসলাম জানালেন, আট মাস আগে দৈনিক ৪৯০ টাকা হাজিরা ভিত্তিতে মিলে কাজ নিয়েছেন। ছয় মাসের বেতন পেয়েছেন। দুই মাসের বেতন বকেয়া।

চিনিকলে এসেছেন সদর উপজেলার গলেহা কান্তমণি গ্রামের আজিরুল ইসলাম। তাঁর বাবা মোজাম্মেল হক যন্ত্রচালক ছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি মারা যান। আজিরুল এসেছেন বাবার পেনশনের টাকার জন্য কথা বলতে। কিছু টাকা পেয়েছেন। আরও পাওনা আছে। এর মধ্যে চিনিকলটি বন্ধের কথা শুনে তিনিও চিন্তিত।

সংকটের শুরু যেখানে

১৯৬৫ সালে পঞ্চগড়ের ধাক্কামারা এলাকায় ১৯৮ দশমিক ৪৬ একর জমিতে পঞ্চগড় চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। পরীক্ষামূলকভাবে চিনি উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬৯ সালে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে চিনিকলটি জাতীয়করণ করা হয়।

কলটির বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ১০ হাজার মেট্রিক টন। ২০০৫ সাল পর্যন্ত চিনিকলটিতে গড়ে ৮ হাজার ৫৩৬ টন চিনি উৎপাদিত হতো। এতে লাভেই ছিল প্রতিষ্ঠানটি। সবশেষ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা মুনাফা আসে এখান থেকে।

কিন্তু চিনির লাভ আর বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ২০০৬ সাল থেকে ধারাবাহিক লোকসান পর্ব চলতে থাকে। এভাবে ১৪ বছর ধরে টানা লোকসান করে যাচ্ছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি।

চিনিকলের হিসাব শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরেও লোকসান হয়েছে ৪৮ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসান ছিল ৬৩ কোটি টাকা। সব মিলে এ প্রতিষ্ঠানের লোকসান ৪৭০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

তবে চিনিকলের ব্যবস্থাপক (অর্থ) মুহাম্মদ নাজমুল হুদা বলছেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫ কোটি টাকা কম লোকসান হয়েছে। গত মৌসুমে সরকার চিনিকলকে আখ ক্রয় বাবদ ৫ কোটি ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ ৭০ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। ফলে আখচাষিরা আখ বিক্রির টাকা ঠিকমতো পেয়েছেন। শ্রমিক-কর্মচারীরাও কম-বেশি বেতন পাচ্ছেন।

লোকসানের কারণ

চিনিকলসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একসময় পঞ্চগড় জেলায় প্রচুর আখ চাষ হতো। ফলে চিনিকলটি লাভজনক ছিল। কিন্তু দেড় দশকে আখ চাষ অনেক কমেছে। চিনি উৎপাদনও কমেছে।

এ ছাড়া কলের যন্ত্রপাতি পুরোনো। ফলে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উৎপাদন কমেছে। উল্টো বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ। চিনিকলটির ঋণের পরিমাণ ১৯২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ঋণের সুদ দিতে গিয়েও বাড়ছে লোকসান। প্রতিষ্ঠানটিকে এ বছরও ২৮ কোটি টাকা ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে।

ব্যবস্থাপক নাজমুল হুদার মতে, সরকার চিনিকলের ঋণ মওকুফ করলে লোকসান অনেকাংশে কমে আসবে এবং এটির পুনরুজ্জীবন সম্ভব।

আখের অভাবে গত বছর চিনি উৎপাদিত হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৪১৪ মেট্রিক টন। প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫০ টাকা। কিন্তু বিক্রয় মূল্য সরকার নির্ধারিত ৬০ টাকা। ফলে প্রতিবছর লোকসান বাড়ছে। এ ছাড়া আগের উৎপাদিতসহ মোট ৩ হাজার ২৬১ মেট্রিক টন চিনি অবিক্রীত আছে, যার দাম প্রায় ২০ কোটি টাকা।

চিনিকলের ব্যবস্থাপক (কারখানা) শাহজাহান করিম বলছেন, উৎপাদিত চিনি বিক্রি করাও মুশকিল। কারণ, বাজারে প্রাইভেট কোম্পানির চিনি ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে ডিলাররা ৬০ টাকা কেজিতে এই চিনি নিতে চান না।

চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন-বোনাস মিলিয়ে বছরে ১৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু আখের সরবরাহ স্বল্প। কল চলে দুই মাস। বাকি সময় অধিকাংশ শ্রমিকের কাজ থাকে না। এতে জনশক্তির ব্যবহার যথাযথ হয় না।

আখ চাষ কমছে কেন

পঞ্চগড়ের যেসব এলাকা আখ চাষের জন্য সব থেকে পরিচিত, তার মধ্যে অন্যতম সুরিভিটা। বছর দশেক আগে এখানকার কৃষকেরা ১ একর থেকে ১৫-২০ একর জমিতে আখ চাষ করতেন। কিন্তু এখন?

পঞ্চগড় সদর ইউনিয়নের এই এলাকায় আখচাষিকে খুঁজে পেতে হন্যে হতে হলো। সুরিভিটা গ্রামের মুদিদোকানের টংয়ে বসা একসময়ের আখচাষি আইবুল হককে (৫০) জিজ্ঞেস করি, ‘আখ চাষ বাদ দিলেন কেন?’ প্রশ্ন কেড়ে নিয়ে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘চাষ করে কী হবে?’

আইবুল হক সর্বশেষ আট-নয় বছর আগে ১৩ একর জমিতে আখ চাষ করেছিলেন। কিন্তু আখ বিক্রির সময় তাঁকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। মিলে আখ দিয়ে কয়েক মাস টাকার জন্য ঘুরেছেন। দেনায় পড়ে আখ সরবরাহের ভাউচার কপি মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে বিক্রি করেছেন। এসব ভোগান্তি থেকে বাঁচতে তিনি আখ চাষ ছেড়ে দিয়েছেন।

আইবুলের পাশে বসা ছিলেন ওসমান আলী (৩০)। তিনি গত বছর দুই বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন। তিনি বলছেন, চিনিকল আগের থেকে কিছুটা ভালো চলছে। গতবার তাঁকে সার, বীজ ও নগদ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। আখ বিক্রির টাকাও ১৫ দিনের মধ্যে পেয়েছেন। তবু তাঁর আগ্রহ নেই আখ চাষে। কেন?

ওসমানের হিসাবে, দুই বিঘা জমিতে আখের উৎপাদন হয়েছে ৪০০ মণ। দাম পেয়েছেন ৪০ হাজার টাকা। বিপরীতে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। সারা বছর খাটুনির পর মাত্র ১০ হাজার টাকা পেয়ে খুশি নন তিনি।

পঞ্চগড় শহর থেকে দেবনগর, ভিতরগড়, দশমাইল, অমরখানা, জগদল, ভজনপুর এলাকা ঘুরে দেখি, কৃষকেরা চা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। তাঁরা বলছেন, আখের চেয়ে চায়ে লাভ বেশি।

চিনিকলের ব্যবস্থাপক (কৃষি) মোস্তফা কামাল বলছেন, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে আখচাষিদের বিশেষ ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এতে দুই বছর ধরে তুলনামূলক আখের চাষ বাড়ছে।

পঞ্চগড়-১ আসনের সাংসদ মজহারুল হক প্রধান কেন্দ্রীয় আখ চাষি ফেডারেশনের সভাপতি। তিনি বলছেন, আখ চাষ কমেছে, এটা সত্য। তবে আখের স্বল্পকালীন উন্নত জাত উদ্ভাবন করতে পারলে এটি আবারও জনপ্রিয় হবে।

ভবিষ্যৎ কোন পথে

স্থানীয় লোকজন বলছেন, বেসরকারীকরণ নয়, দরকার আধুনিকায়ন। চিনিকলটিকে বিকল্প আয়ের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বহুমুখী প্রকল্প নিতে হবে।

চিনিকলটি ঘিরে কয়েকটি প্রস্তাব বিএসএফআইসির কাছে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার বলেন, শুধু চিনি উৎপাদন করে এ প্রতিষ্ঠান টেকানো সম্ভব নয়।

পঞ্চগড় নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক এরশাদ হোসেনও বেসরকারীকরণের বদলে এর আধুনিকায়ন চান। তাঁর মতে, জেলার একমাত্র ভারী শিল্পকারখানাটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় ভীষণভাবে প্রভাব পড়বে।