চুনতি অভয়ারণ্যের চার হাজার একর বনভূমি বেদখল, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
চুনতি বনে মানুষের বসতি
এশীয় হাতির বিচরণের নিবিড় স্থান চুনতি অভয়ারণ্য মানুষের দখলের কবলে পড়েছে। বনের প্রায় চার হাজার একর জমি দখল করে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। ফলে এই বন থেকে বন্য প্রাণীরা সরে যাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে গড়ে ওঠা মানববসতি এভাবে বাড়তে থাকলে এই বন থেকে বন্য প্রাণীরা চিরতরে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নরম মাটি, ঝরনা আর ভূগর্ভস্থ পানিপ্রবাহের কারণে এই বনটি হাতির প্রজননক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহূত হয়। বন সংরক্ষণের জন্য জাতিসংঘের ইকুয়েটর পুরস্কারজয়ী এই বনের চার হাজার একর জমিতে এখন মানববসতি গড়ে উঠেছে। এতে এই বনের বাসিন্দা বন্য প্রাণীরা বিপদে পড়েছে। তারা এখন বনছাড়া হতে চলেছে।
বন বিভাগের সূত্র এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জীববৈচিত্র্যপূর্ণ চুনতি বনের এই চিত্র উঠে এসেছে।
গর্জন, চাপালিশ, বাঁশ, বেত, গুল্ম, ঘাসসহ প্রায় ১০৭ প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে এই বনে। এ বনে রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫৩ প্রজাতির পাখি, চার প্রজাতির উভচর ও সাত প্রজাতির সরীসৃপ। জীববৈচিত্র্য ও বন্য প্রাণীর আধার এই বনে এখন প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসতি।
অভয়ারণ্যের চুনতি রেঞ্জের আওতাধীন আজিজনগর বিটসংলগ্ন কলাতলী এলাকায় সম্প্রতি গিয়ে করুণ দৃশ্য চোখে পড়ে। বনের ভেতর গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি। স্থানীয় লোকজন জানান, ১৫-২০ বছর আগে মানুষ কলাতলী এলাকায় গহিন অরণ্যের কারণে একা হেঁটে যেতে ভয় পেত। অভিযোগ রয়েছে, বিট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ৩০-৪০ বছর ধরে চুনতি অভয়ারণ্যে জবরদখল চলছে। গর্জনগাছের মা-বৃক্ষ কদাচিৎ চোখে পড়ে। ঘর বানাতে কাটা পড়েছে ওই গাছগুলো।
বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চকরিয়া ও বাঁশখালী এলাকায় ১৯ হাজার ১৭৭ একর জমি নিয়ে চুনতি সংরক্ষিত অভয়ারণ্য এলাকা গড়ে উঠেছে।
অভয়ারণ্যের সহব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি আনোয়ার কামাল জানান, বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় চুনতি অভয়ারণ্যের সাড়ে তিন থেকে চার হাজার একর জায়গা জবরদখল হয়েছে এবং ঘরবাড়ি নির্মাণ চলছেই। গত ছয় মাসে প্রায় এক হাজার একর জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। সরকারি অর্থায়নে রোপণ করা সেগুনবাগান, শালবাগান, বেতবাগান ধ্বংস করে তা হচ্ছে।
চুনতি বিট কর্মকর্তা আবদুল মতিন প্রথম আলোকে জানান, এই অভয়ারণ্যের শুধু চুনতি রেঞ্জের আওতায় প্রায় পাঁচ হাজার অবৈধ দখলদার রয়েছে। এসব দখলদার অবৈধভাবে ঘরবাড়ি, মৎস্য প্রকল্প, অবৈধ বাগান, পানের বরজ তৈরি করে জায়গা দখল করছে।
অভয়ারণ্যের সহব্যবস্থাপনা কমিটি ও সংশ্লিষ্ট সাত বিট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে চার হাজার একর বন দখলের প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট বিট কর্মকর্তাদের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, চুনতিতে এক হাজার ২০০ একর, আজিজনগরে এক হাজার একর, হারবাং এলাকায় ৫০০ একর এবং বাঁশখালী রেঞ্জ এলাকায় চারটি বিটে প্রায় এক হাজার ৩০০ একর জমি বেদখল হয়ে আছে।
বন কর্মকর্তাদের মতে, চুনতি বিটের গজালিয়া, খাঁচার পুকুর, পাগলীর গোদা, কুলপাগলী, রশিদার ঘোনা, ঢুলইন্যা, মুরংঘাটা ও বিট অফিসসংলগ্ন অভয়ারণ্যের অধিকাংশ জায়গা বেদখল হয়ে আছে।
এ ছাড়া আজিজনগর এলাকার কলাতলী, গাইনাকাটা, ভিলেজারপাড়া, ডলু বন্যা গোদা ও বিট অফিসসংলগ্ন এবং হারবাং বিট এলাকার গয়ালমারা, ইছাছড়ি এবং নয়াবাজারের পশ্চিম পাশে অভয়ারণ্যের জায়গা বিভিন্ন ব্যক্তি দখল করে রেখেছে। একই অবস্থা বাঁশখালীর পুঁইছড়ি, নাপোড়া, চাম্বল, জলদি এলাকায়।
অভয়ারণ্যের ভেতর থাকা কলাতলী এলাকার শাকেরা বেগম, রেহেনা, গুলমেহের প্রথম আলোকে বলেন, বন বিভাগের কর্মকর্তা এবং জায়গার মালিককে টাকা দিয়ে তাঁরা এখানে বসবাস করছেন। আজিজনগর কলাতলীর বাসিন্দা আবদুল জলিল জানান, আজিজনগর এলাকায় পাঁচ শতাধিক পরিবার বন বিভাগের জায়গায় বসবাস করে। তার মধ্যে ৫০টি রোহিঙ্গা পরিবার রয়েছে। তিনি নিজেও ১০ বছর আগে বন বিভাগের তৎকালীন কর্মকর্তাদের ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটি ঘর তৈরি করেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, আজিজনগর বিট এলাকায় আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে স্থানীয় যুবলীগের নেতা মো. তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে চুনতি অভয়ারণ্যের জায়গা দখল ও বাড়ি নির্মাণ চলছে।
জানতে চাইলে তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘অভয়ারণ্যের জায়গায় ৮-১০টি ঘর নির্মাণ করেছি নিজে থাকার জন্য।’ তিনি আজিজনগর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি বলে জানান।
বন বিভাগের আজিজনগর বিট কর্মকর্তা ননী গোপাল রায় টাকার বিনিময়ে ঘর তৈরি করে দেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘তোফায়েলের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে ১২টি বন মামলা দিয়েছি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ প্রথম আলোকে জানান, তিনি ১৯৯০ সাল থেকে চুনতি অভয়ারণ্যের বন ও পরিবেশের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন, যে হারে অভয়ারণ্যে অবৈধ বসতি ও জবরদখল বেড়েছে, তাতে চুনতি অভয়ারণ্যে কয়েক হাজার একর বনভূমি ইতিমধ্যে বেদখল হয়েছে। এতে অভয়ারণ্যের ভেতর থাকা বন ও বন্য প্রাণী মারাত্মক হুমকির মুখে।
অভয়ারণ্যের চুনতি রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল হাসেম ও বাঁশখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা বাদল কান্তি দাশ বলেন, সত্তরের দশক থেকে এখানে অবৈধ জবরদখল চলছে। বনের জায়গা জবরদখল ও বাড়ি নির্মাণের জন্য স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীরা দায়ী। তবে কাঠ পাচারকারী ও অবৈধ দখলদারদের সঙ্গে বন কর্মকর্তাদের সখ্যের অভিযোগ অস্বীকার করেন তাঁরা।
চুনতি বন্য প্রাণী ও অভয়ারণ্যের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) খালেক খান দীর্ঘদিন ধরে চলা অবৈধ দখলের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি প্রশাসনের সহযোগিতায় এদের উচ্ছেদ করতে। টাকার বিনিময়ে অবৈধ দখলে সহায়তা ও গাছ কাটার প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’