‘কেউ অপরাধ করলে চেষ্টা করে নিজেকে বাঁচানোর’

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

প্রত্যেক মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাই হলো নিজেকে বাঁচানো। কেউ অপরাধ করলে চেষ্টা করে নিজেকে বাঁচানোর, না করলেও একই চেষ্টা করে। কোনো ব্যক্তি ছোট-বড়-মাঝারি যে অপরাধই করুক না কেন, চট করে তা স্বীকার করতে চায় না—এসব বিষয় উল্লেখ করে উচ্চ অদালত নারায়ণগঞ্জে ‘মৃত’ কিশোরীর জীবিত ফেরত আসার আগে তার পরিবারের করা মামলার তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

ওই ঘটনা নিয়ে করা এক আবেদনের শুনানিতে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, সাধারণত চুরি করলেও তো কেউ স্বীকার করতে চায় না। আবার স্বীকার করলেও বলে ভুলে নিয়ে গেছে।

বৃহস্পতিবার আবেদনের শুনানিতে ওই মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উপপরিদর্শক (সাময়িক বরখাস্ত) শামীম আল মামুনের আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, এটি কি মানুষের স্বাভাবিক আচরণের মধ্যে পড়ে? যেখানে সে (স্বীকারোক্তি প্রদানকারী) জানে তার পরিণতি কী? অথচ দুটি বিষয় স্বীকার করছে—ধর্ষণ করেছে, তারপর নদীতে ফেলে দিয়েছে। এ ধরনের অপরাধ একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কি কেউ স্বীকার করে?

পরে আদালত ২৪ সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য দিন ধার্য করেন।

গত ৪ জুলাই ১৫ বছর বয়সের এক কিশোরী নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকার বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। পরিবারের লোকজন তাকে না পেয়ে থানায় প্রথমে জিডি ও পরে মামলা করে। ওই মামলায় পুলিশ আবদুল্লাহ, রকিব ও খলিলুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরা কিশোরীকে অপহরণ ও ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা ‘স্বীকার করে’ গত ৯ আগস্ট আদালতে জবানবন্দি দেন। তবে ‘অবিশ্বাস্যভাবে’ ঘটনার ৫১ দিন পর গত ২৩ আগস্ট ওই কিশোরী ফিরে আসে। পরে সে জানায়, এক যুবককে বিয়ে করে বন্দর এলাকার ভাড়াবাড়িতে সংসার করছে সে। এরপর আদালত পরে ওই কিশোরীকে তার পরিবারের জিম্মায় দেন।

‘মৃত’ মেয়েটির ফেরা, প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত’ শিরোনামে গত ২৫ আগস্ট প্রথম আলোয় এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি যুক্ত করে ওই কিশোরীকে অপহরণের অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মেয়েটির বাবার করা মামলার নথিপত্র তলব ও তা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে সেদিনই সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ আইনজীবী একটি আবেদন (রিভিশন) করেন। সেদিন হাইকোর্ট আসামিদের গ্রেপ্তার ও স্বীকারোক্তি রেকর্ড বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আল মামুনকে ১৭ সেপ্টেম্বর হাজির হতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে মামলার সিডি (মামলার নথি) নিয়ে আসতে বলেন। গতকাল দুই কর্মকর্তা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

মেয়েটি ফিরে আসার পর এই মামলার আসামি আবদুল্লাহর বাবা আমজাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মারধর করে তাঁর ছেলেসহ অন্যদের কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে।

এদিকে শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে নানা ধরনের অভিযোগ দেখা যায়। এগুলোতে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়। কিছুদিন আগে পত্রিকায় এসেছে, থানার ওসি ঘুষের টাকা নেওয়ার আগে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে নিচ্ছেন। পরে দেখলাম তাঁকে ওই থানা থেকে সরিয়ে আরেক থানায় দেওয়া হয়েছে। শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া, তারপর এখানে ক্লোজড (প্রত্যাহার), ওখানে ক্লোজড, সেখানে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) দেখা যায়।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন, সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হাছিনা মমতাজ। এ ছাড়া আদালতের অনুমতি নিয়ে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী তৈমুর আলম খন্দকার।

জবানবন্দি গ্রহণ ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় আসামির আইনজীবীর উপস্থিতি এবং অডিও-ভিডিও রেকর্ড সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা দিতে শুনানিতে আরজি জানান আইনজীবী শিশির মনির। তিনি বলেন, এটি সব পক্ষের জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।

শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেন, ফেয়ার ইনভেস্টিগেশন (নিরপেক্ষ তদন্ত) ও ফেয়ার ট্রায়ালের (নিরপেক্ষ বিচার) পূর্বশর্ত হলো কম কথা বলা। এখন একটা ঘটনা ঘটলে অনেক কথা হয়। আবার তদন্ত কীভাবে হচ্ছে ও কীভাবে হলো, এটির ওপর প্রতিদিন টক শোও হয়। ট্রায়ালের ওপর টক শো হয়।

ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) ওপর হামলার তদন্তের বিষয়ে গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন প্রসঙ্গে আদালত বলেন, একজন বলেছেন ৪০ লাখ টাকা উদ্ধার হয়েছে। আরেক পত্রিকায় একই এসপি বলছেন, উদ্ধার হয়নি। মানুষ তো বিভ্রান্ত হচ্ছে। এসব কারণে তদন্তও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন এজেন্সি (সংস্থা) বিভিন্ন কথা মিডিয়ায় বলে। যারা তদন্ত সংস্থা ও বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, তাদের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।