চুল নিয়ে চুলোচুলি কেন করি

প্রতীকী ছবি

চুল মানবদেহের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। যাঁদের চুল ঠিকমতো নেই বা ঝরে পড়ছে, তাঁরাই বোঝেন চুল না থাকার মর্ম কী! আবার কাউকে শায়েস্তা করার শারীরিক তরিকা বের করতে আজকের দিনেও অনেকেই চুলের শরণাপন্ন হন। আমাদের দেশে কয়েক বছর ধরে এমনটা আরও বেশি হচ্ছে। প্রশাসন থেকে শিক্ষক—সবাই হাত দিচ্ছেন তরুণদের চুলে। সবক শেখানোর জন্য চুল নিয়ে চুলোচুলি আসলে কেন করা হয়?

চুল নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অযাচিত ঘটনার সাম্প্রতিক উদাহরণটি সৃষ্টি হলো বিশ্বকবির নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার হলে ১৪ শিক্ষার্থীর চুল কেটে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করে। এরপর সেই শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন। অবশ্য অভিযুক্ত শিক্ষক চুল কাটার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

শিক্ষার্থীদের চুল কাটার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক ফারহানার বিরুদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থীদের বিষয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও খারাপ আচরণের একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। কর্তৃপক্ষ এখন বলছে, সব অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। যদিও শিক্ষার্থীরা বলছেন, খারাপ আচরণ করার ঘটনা আগে হলেও শিক্ষক ফারহানার উগ্র আচরণ ও ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে কেউ নাকি প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না।

এভাবে জোর করে চুল কেটে দেওয়ার সঙ্গে ব্যক্তিগত অপমানের অনুভূতি বেশ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েও তা হয়েছে এবং একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা করার চেষ্টার কথা আমরা জেনেছি। যদিও এ সমাজে বয়সে ছোটদের মান–অপমান নিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক বয়োজ্যেষ্ঠরা একটু কমই ভাবেন। তাই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার ঢের ঘটনা যে কেউ নিজের জীবন থেকেই সংগ্রহ করতে পারবেন। গঠনমূলক আলোচনা নয়, বরং তখন ‘সার্বিক কল্যাণের’ দোহাই দেওয়া হয়। হয়তো শিক্ষক ফারহানাও তেমনটাই ভেবেছিলেন। তিনিও তো এই ত্রুটিজর্জর সমাজেরই একজন। তার ওপর আবার যুক্ত হয়েছে ক্ষমতার বড়াই। ফলে চুল কাটা আর কি এমন বিষয়!

ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের এক গবেষণায় জানা যায়, এভাবে লজ্জার অনুভূতি দিয়ে মূলত একজনের আপাত ‘নেতিবাচক আচরণ’ সংশোধনের চেষ্টা করা হয়। এটি কখনো কখনো উদ্দেশ্য পূরণে কাজেও আসে। তবে ব্যক্তিস্বাধীনতার এই যুগে এমন কৌশল কতটা কুশলী, তা নিয়েও বিতর্ক আছে ঢের। আর নেতি বা ইতির বিষয়টিও তো আপেক্ষিক। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে কর্তৃপক্ষীয় জোর দেখানো ব্যক্তির প্রতি অনেকের প্রচণ্ড বিবমিষা সৃষ্টি হতে পারে। আমরা নিশ্চয়ই পারস্পরিক ঘৃণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি সমাজ চাই না। নাকি চাই?

জোর যার মুলুক তার—এমন এক সংস্কৃতি যখন কোনো দেশে গড়ে ওঠে, তখন এমন ঘটনা বারবার ঘটে। এসব ঘটনার মূল ফলাফল হচ্ছে, একজনের ব্যক্তিগত অধিকারে জোর করে হস্তক্ষেপ করা। এর মধ্য দিয়ে উদ্দিষ্ট মানবসন্তানকে বোঝানো হয়, তোমার জীবনের নিয়ন্ত্রণ আসলে তোমার হাতে নেই। যখন–তখন গায়ে হাত দেওয়াও ‘ওয়ান–টু’র ব্যাপার। সেই সঙ্গে দেওয়া হয় লজ্জার প্রচণ্ড অনুভূতি। যাতে ভবিষ্যতে কর্তৃপক্ষের যেকোনো অন্যায় আবদারের প্রতিবাদ করার আগে একজন অন্তত নিজের মানসম্মান রক্ষার বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে যেতে পারেন।

চুল নিয়ে হুলুস্থুলও তেমনি। ঠিক দুই বছর আগেও এমন ঘটনা আলোচিত হয়েছিল। সেই সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় চুল-দাড়ি কাটার ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের নানান ‘বিধিনিষেধ’ আরোপের খবর পাওয়া গিয়েছিল। তখন চুল কীভাবে কাটতে হবে, তা নিয়ে মোট আট জেলায় প্রশাসন, পুলিশ ও শিক্ষা কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছিলেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। কোথাও কোথাও কিশোর-তরুণদের শাসানোর অভিযোগও পাওয়া যায়। এমনকি কিছু জায়গায় নরসুন্দরদের কাছ থেকে ক্যাটালগ সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তও হয়েছিল বলে সংবাদমাধ্যমে জানা গিয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসন তখন বলেছিল, তারা ‘বখাটে কাটিং’ থেকে বিরত থাকতে বলেছে। আর মাগুরা জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) বলেছিলেন, নাগরিকের মানবাধিকার ক্ষুণ্ন বা ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে নয়, বরং কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সচেতন করতে চুলে ‘বখাটে কাটিং’ না দিতে প্রচারণা চালানো হয়।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, চুলই মনে হয় সকল ভুলের মূল। আদতে কোনো সামাজিক বা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আজ পর্যন্ত এমন ধারণা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করার মতো তথ্য–উপাত্ত মেলেনি। তবে প্রকাশ্যে শাস্তির মাধ্যমে কাউকে অপমান করার উপায় হিসেবে অনেক আগে থেকেই মানুষের চুলে কাঁচি চালানোর উদাহরণ পাওয়া যায়। ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত আইরিশ যুদ্ধ চলেছিল। ওই সময়ে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির কিছু কিছু সদস্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে শাস্তি হিসেবে অনেক নারীর চুল জোর করে কেটে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। এই চুল কাটার বিষয়টি সামাজিকভাবে এতটাই অপমানসূচক ছিল যে অনেক নারী চুল কাটার বদলে নিজের প্রাণ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না বলে তৎকালীন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।

এতদঞ্চলেও শাস্তি হিসেবে চুল কাটা, মাথা ন্যাড়া করে এলাকায় ঘোরানোর সংস্কৃতি পাওয়া যায়। দেশে অতীতে সামরিক শাসনের শুরুতে লম্বা চুল কেটে দেওয়ার উদাহরণ আছে। একবিংশ শতাব্দীতেও এমন ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। স্রেফ অন্তর্জালে খুঁজুন। এমন খবরের হদিস আপনার হাতের নাগালে চলে আসবে। এরপর স্ক্রল করে কূল পাবেন না!

শেষটায় কিংবদন্তি সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের একটি ছড়ার কথা বলি। তিনি লিখেছিলেন,
বাস্‌‌রে বাস্‌‌ ! সাবাস্‌‌ বীর !
ধনুকখানি ধ’রে,
পায়রা দেখে মারলে তীর-
কাগ্‌‌টা গেল ম্’রে !

এমন বীর আমরা হর–হামেশাই পাচ্ছি। কিন্তু পায়রা মারতে গিয়ে তির যে অন্য কারও গায়ে লাগছে, তার বেলা?