চৌদ্দ শিকে বন্দী ওদের শৈশব

দেশের ৬৮টি কারাগারে ৩৪৯ শিশু মায়ের সঙ্গে আছে

  • দেশে বন্দী মোট -৮১,৫৫৩ জন, নারী -৩,২৪২ জন

  • মাত্র টি কারাগারে শিশু দিবাযত্নের ব্যবস্থা রয়েছে।

  • আসামি মা চাইলে তাঁর সঙ্গে বছরের কম বয়সী শিশুকে কারাগারে রাখতে পারেন।

হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি হিসেবে ২৫ বছরের রাহেলা (ছদ্মনাম) মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে (কাশিমপুর-৩) বন্দী আছেন। তাঁর স্বামী মামলার প্রধান আসামি। তিনি কারাগারের পুরুষ অংশে আছেন। এই কারাগারের মোট বন্দী তালিকায় রাহেলার নামধাম থাকলেও তাঁর সঙ্গে বাস করা একটি ছোট্ট প্রাণ সেই তালিকায় নেই। কোনো অপরাধের অভিযোগও নেই তার বিরুদ্ধে। দেড় বছর ধরে রাহেলার সঙ্গে কারাগারে দিন কাটাচ্ছে তাঁর শিশুসন্তান। মায়ের বিরুদ্ধে যে অপরাধের বিচার চলছে, তার দায় ছোট্ট ঘাড়ে নিয়ে আক্ষরিকভাবেই চার দেয়ালে বন্দিজীবন কাটছে শিশুটির।

রাহেলার মতো রিনাও (ছদ্মনাম) কাশিমপুর কারাগারে প্রবেশের সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তাঁর সন্তানের জন্ম এই কারাগারেই। রিনার বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। তাঁর মা জানান, কারাগারে যাওয়ার সময় মেয়ে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। কারাগারের ভেতর পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। ছেলের বয়স এখন এক বছর। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির আগে তিনি একবার মেয়ে ও নাতিকে দেখে এসেছিলেন। আর যাওয়া হয়নি।

নারী বন্দীদের সঙ্গে ছোট্ট শিশুটিও থাকে। তাদের মানসিক বিকাশ ও শিক্ষায় কয়েকটি কারাগারে শিশু দিবাযত্নের ব্যবস্থা রয়েছে।

রাহেলা ও রিনার সন্তানদের মতো সারা দেশের ৬৮ কারাগারে মায়ের সঙ্গে থাকা শিশুর সংখ্যা ৩৪৯। ৪ অক্টোবরের এ হিসাব প্রথম আলোকে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। এই সময় দেশে মোট বন্দী রয়েছে ৮১ হাজার ৫৫৩ জন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৩ হাজার ২৪২। কারাগারে থাকা শিশুদের মানসিক বিকাশ ও প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষায় মাত্র ৭টি কারাগারে শিশু দিবাযত্নের ব্যবস্থা রয়েছে। মায়ের সান্নিধ্য পাওয়া ছাড়া বাকি কারাগারগুলোতে থাকা শিশুর মানসিক বিকাশে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই।

কারা অধিদপ্তর জানিয়েছে, কারাবিধি অনুসারে আসামি মা চাইলে তাঁর সঙ্গে ছয় বছরের কম বয়সী শিশুসন্তানদের কারাগারে রাখতে পারবেন। ছয় বছর বয়সের পর ওই শিশুকে কারাগার থেকে বাবার কাছে দেওয়া হয়। বাবাও জেলে থাকলে বা না থাকলে মায়ের সম্মতিতে স্বজনদের কাছে দেওয়া হয়। স্বজন না থাকলে ওই শিশুকে ‘সুবিধাবঞ্চিত শিশু’ হিসেবে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত কোনো সংস্থায় রাখা হয়।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় কারাগারে প্রবেশে কড়াকড়ি রয়েছে। অনেক কারাবন্দীর স্বজনেরাও এখন দেখা করার সুযোগ পাচ্ছেন না। এই অবস্থায় কারাগারে সন্তানসহ রয়েছেন এমন ছয় নারী বন্দীর পরিবারের সঙ্গে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। আরও চারটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলেও তাঁরা এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।

কারাগারের শিশুদের মানসিক বিকাশ জরুরি

শিশুর মানসিক উন্নয়নে জন্মের পর পাঁচ বছর বয়স খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার। তিনি বলেন, এই বয়সের শিক্ষা শিশুর আস্থা, সম্পর্ক ও দক্ষতার ওপর প্রভাব ফেলে। শিশুরা চারপাশ থেকে দেখে শেখে। কারাগার হচ্ছে বিশেষ ধরনের পরিবেশ। প্রচলিত সমাজের সঙ্গে মিল নেই। কারাগার প্রচলিত সামাজিক আচার-আচরণকে প্রতিনিধিত্ব করে না।

কারাগারের শিশুদের মানসিক বিকাশে খেলাধুলা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে মেখলা সরকার বলেন, এই শিশুরা অবহেলার শিকার হলে তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হতে পারে। শিশুকে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে, গুরুত্ব আছে, সে বোধ দিতে হবে।

শিশুদের জন্য কী আছে কারাগারে

২০১২ সালের জুনে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে মায়ের সঙ্গে বন্দী শিশুদের জন্য প্রথমবার শিশু দিবাযত্ন পরিচালনা করে বেসরকারি সংগঠন অপরাজেয় বাংলাদেশ। ওই সময় সেখানে শিশুর সংখ্যা ছিল প্রায় অর্ধশত। সংগঠনটির বারবার তাগিদের পর ২০১৫ সালের ২৯ মার্চ মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, দেশের যেসব কারাগারে মা বন্দীর সঙ্গে ১০ জনের বেশি শিশু রয়েছে, তাদের বয়স কমপক্ষে সাত-আট বছরের নিচে হলে ওই সব কারাগারে দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করা হবে। ওই বছরের ৩১ মে দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয় অপরাজেয় বাংলাদেশকে। ওই সময় থেকে কাশিমপুর, বগুড়া, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খুলনা, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা শুরু করে সংগঠনটি। দিবাযত্ন কেন্দ্রে যেসব উপকরণ আছে তা হচ্ছে—বই, আদর্শলিপি, খাতা, কলম, পেনসিল, স্লেট, চক, বিল্ডিং ব্লকস, ছবি আঁকার বোর্ড, বল, রং পেনসিল, খেলনা প্রভৃতি।

এই শিশুরা অবহেলার শিকার হলে তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হতে পারে। শিশুকে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে, গুরুত্ব আছে, সে বোধ দিতে হবে।
মেখলা সরকার, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক

অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল ওই শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া, খেলাধুলার পরিবেশ তৈরি করা। শিশুদের মূল যত্ন মায়েরাই করবেন। কিন্তু শিশুরা যেন বুঝতে না পারে যে ওরা স্বাভাবিক পরিবেশে নেই। মা যতই অপরাধ করুক, সেটার দোষ তো শিশুর নয়। আমরা চাই প্রতিটি কারাগারে দিবাযত্ন কেন্দ্র করা হোক।’

সাবেক কারা মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজনস) অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন এখন কানাডার ওন্টারিওতে আছেন। হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, তাঁর মেয়াদে (২০১৪-২০১৯) কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে এই শিশুদের জন্য শিশু পার্ক করে দেওয়া হয়েছিল। দেয়ালজুড়ে মিকিমাউসসহ বিভিন্ন চিত্র আঁকা হয়। একবার কাশিমপুর কারাগারের শিশুদের শিশু পার্কে এবং কক্সবাজার কারাগারের শিশুদের সৈকতে ঘুরিয়ে আনা হয়েছিল। তিনি বলেন, মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেখানে-সেখানে থাকার চেয়ে কারাগারে মায়ের সঙ্গে বসবাসের সুযোগ দেওয়ার নিয়মটাই ভালো। ১০ জনের বেশি শিশু হলে শিশু দিবাযত্ন করে আলাদাভাবে শিক্ষক রাখা হয়। এর কম শিশু হলে কারাগারের ভেতরের ব্যবস্থাপনা দিয়ে দেখভাল করা হয়। পড়ালেখা জানা নারী বন্দীরা ওই শিশুদের পড়ান।

জানতে চাইলে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. আবরার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এক মায়ের সঙ্গে কয় শিশু থাকতে পারবে, সে ব্যাপারে ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই। ছয় বছরের নিচের বয়সের যত সন্তান মায়ের থাকবে, তত সন্তানই থাকার সুযোগ পায়। তারা খোলা জায়গায় চলাচল করে, সব ধরনের সুবিধা পায়। মা অপরাধ করেছেন, সন্তান তো কোনো অপরাধ করেনি। তাকে কেন মায়ের আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত করা হবে।