চৌর্যবৃত্তির অভিযোগের পর তাঁরা বললেন ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণা নিবন্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে উঠেছে। এই গবেষণা নিবন্ধের ভিত্তিতে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিরও আবেদন করেছিলেন তাঁরা। চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ জমা পড়ার পরপরই আবেদন প্রত্যাহার করে নেন দুই শিক্ষক। তাঁরা বলছেন, নিজেদের অজান্তে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ হয়েছে।

ওই দুই শিক্ষকের যৌথ গবেষণা ‘ওয়েন কালচার বিকামস কমোডিটি: ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ইন দ্য চিটাগং হিলট্র্যাকটস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে চৌর্যবৃত্তি খুঁজে পান গবেষক হানা শামস আহমেদ।

এই দুই শিক্ষক হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস এম সাদাত আল সাজিব ও মুহাম্মদ কাজীম নূর সোহাদ। তাঁদের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ এনেছেন কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের পিএইচডি গবেষক বাংলাদেশি নাগরিক হানা শামস আহমেদ। আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা স্প্রিংগারের ওয়েবসাইটে দুই শিক্ষকের যৌথ গবেষণা ‘ওয়েন কালচার বিকামস কমোডিটি: ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ইন দ্য চিটাগং হিলট্র্যাকটস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধ নিয়ে এ অভিযোগ। এতে হানা শামস আহমেদ তাঁর প্রবন্ধ থেকে বেশ কিছু অংশ চৌর্যবৃত্তি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগকারী হানা শামস আহমেদের সঙ্গে ই-মেইল ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, গত ১৪ এপ্রিল স্প্রিংগারের সিঙ্গাপুরের সম্পাদকীয় পরিচালক উইলিয়াম অ্যাকাউর ও সম্পাদক আনুশাঙ্গি ভিরাকুনের কাছে তিনি চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ জানান। বিষয়টি তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান ও বিভাগের সভাপতি খাদিজা মিতুকে ই-মেইলের মাধ্যমে জানান। তবে এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করেনি।

এই ভুলটি আমাদের অজান্তেই হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে এটি প্রত্যাহারের জন্য বলেছি। আসলে আমরা সহগবেষকের ওপর নির্ভর করেছিলাম। তাঁরা এসব তথ্য আমাদের দিয়েছিলেন। আমরা ব্যবহার করেছি।
মোহাম্মদ কাজীম নূর সোহাদ, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, গত ১৮ মার্চ এস এম সাদাত আল সাজিব ও মুহাম্মদ কাজীম নূর সোহাদ সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন করেন। পদোন্নতির শর্ত হিসেবে তাঁরা আন্তর্জাতিক জার্নাল ও প্রকাশনায় তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার কথা বলেন। এর মধ্যে ছিল স্প্রিংগারে প্রকাশিত নিবন্ধটিও। ওই দুই শিক্ষকের যৌথ গবেষণা ‘ওয়েন কালচার বিকামস কমোডিটি: ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ইন দ্য চিটাগং হিলট্র্যাকটস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে (বুক চ্যাপটার) চৌর্যবৃত্তি খুঁজে পান গবেষক হানা শামস আহমেদ।

তবে অভিযোগ আসার এক দিন পরেই মুহাম্মদ কাজীম নূর সোহাদ তাঁর পদোন্নতির আবেদন প্রত্যাহারের জন্য ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারে কাছে চিঠি দেন। এতে তিনি লিখেন, গবেষণায় ‘উদ্ধৃতি’ এবং ‘প্রসঙ্গ’ উল্লেখজনিত অনভিপ্রেত ও অনিচ্ছাকৃত ভুল থাকায় তিনি পদোন্নতির আবেদন সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করেছেন। এরপর গত ৫ মে পদোন্নতির আবেদন প্রত্যাহার করে নেন আরেক শিক্ষক সাদাত আল সাজিব। তিনিও চিঠিতে একই কথা বলেন।

হানা শামস আহমেদের অভিযোগ, তিনি তাঁর স্নাতকোত্তরের গবেষণা নিবন্ধ তৈরির কাজে চার ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেন। দুই শিক্ষক এ চারজনের নাম ও বক্তব্য তাঁদের গবেষণা নিবন্ধে হুবহু ব্যবহার করেন।

এ ব্যাপারে বিভাগের সভাপতি খাদিজা মিতু প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ খবর লেখার মতো বা অনুসন্ধান করার মতো পর্যায়ে এখনো পৌঁছায়নি। কারণ, এটি এখনো পাবলিক হয়নি। এটি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তও হয়নি। যখন সিদ্ধান্ত হবে, ঘটনা পাবলিক হবে, তখন আপনি অনুসন্ধান করবেন যে কী হয়েছিল ঘটনাটি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান দাবি করেছেন, ই-মেইল পাওয়ার বিষয়টি তাঁর স্মরণে নেই। আর উপাচার্য শিরীণ আখতার বলেন, ই-মেইলে অভিযোগের বিষয়ে তিনি জানেন-ই না। তাঁর কাছে কোনো খবর নেই।’

চৌর্যবৃত্তির সেসব অভিযোগ

স্প্রিংগারে দুই শিক্ষকের গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের এপ্রিলে। আর হানা শামস আহমেদের গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে কানাডার ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ওয়েবসাইটে। হানা শামস আহমেদের অভিযোগ, এটি ছিল তাঁর স্নাতকোত্তরের গবেষণা নিবন্ধ। তিনি এটি তৈরির কাজে চার ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেন। তাঁরা হলেন সাজিব চাকমা, মং শানো চৌধুরী, সামারি চাকমা ও মেঘনা গুহঠাকুরতা। দুই শিক্ষক এ চারজনের নাম ও বক্তব্য তাঁদের গবেষণা নিবন্ধে হুবহু ব্যবহার করেন। পাশাপাশি চারটি অনুচ্ছেদ হুবহু নকল করেন। কিন্তু হানা শামস আহমেদের নাম কোথাও উল্লেখ করেননি।

হানা শামস আহমেদের গবেষণা নিবন্ধের ১৩১, ১৩৫, ১৩৬, ১৩৭, ১৩৮ পৃষ্ঠায় ওই চার ব্যক্তির সাক্ষাৎকার রয়েছে। আর এসব সাক্ষাৎকার দুই শিক্ষকের গবেষণা নিবন্ধের ৩৫১ থেকে ৩৫৪ পৃষ্ঠায় পাওয়া যাবে। অন্যদিকে অনুচ্ছেদগুলো পাওয়া যাবে নিবন্ধের ৩৫১ ও ৩৫২ পৃষ্ঠায়। হানা শামস আহমেদ আরও অভিযোগ করেন, দুই শিক্ষকের গবেষণা নিবন্ধের উপসংহারও চৌর্যবৃত্তি করা হয়েছে। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিনডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুক্তি চাকমার স্নাতকোত্তরের গবেষণা প্রবন্ধ থেকে এ চৌর্যবৃত্তি করা হয়। দুজনের গবেষণা নিবন্ধের উপসংহার প্রায় একই।

যা বললেন দুই শিক্ষক

এস এম সাদাত আল সাজিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘গবেষণা নিবন্ধটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি করেছিলেন অভিযোগকারী। আমরা ইতিমধ্যে প্রকাশককে নিবন্ধটি প্রত্যাহার করে নিতে বলেছি। এটি আসলে অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল ছিল। মূলত মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে তিন শিক্ষার্থীর সহযোগিতা নিয়েছিলাম। তাঁরাই এটি কপি করেছিলেন। আমরা যাচাই না করেই ব্যবহার করি। তাই লেখক হিসেবে দায় আমাদের।’

মোহাম্মদ কাজীম নূর সোহাদ বলেন, ‘এই ভুলটি আমাদের অজান্তেই হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে এটি প্রত্যাহারের জন্য বলেছি। আসলে আমরা সহগবেষকের ওপর নির্ভর করেছিলাম। তাঁরা এসব তথ্য আমাদের দিয়েছিলেন। আমরা ব্যবহার করেছি। আর আমাদের হাতে যাচাই করার মতো কোনো সফটওয়্যারও ছিল না। থাকলে যাচাই করে নিতে পারতাম। এ ভুলটি হতো না। তাই ইতিমধ্যে পদোন্নতির আবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছি।’