চড়া দামে খনন করবে গাজপ্রম, বঞ্চিত বাপেক্স

দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের আবিষ্কৃত ভোলা গ্যাসক্ষেত্রের তিনটি কূপ খননের কাজ বিনা দরপত্রে রাশিয়ার গাজপ্রমকে দেওয়া হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। প্রতিটি কূপ খননে গাজপ্রম পাবে ২১ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার (১৮০ কোটি টাকার বেশি)। দুটি অনুসন্ধান ও একটি উন্নয়ন কূপ খনন করবে এই কোম্পানি। তবে বাপেক্স খনন করলে প্রতিটি কূপে খরচ হতো গড়ে ১০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৮০ কোটি টাকা)। গাজপ্রমকে এত বেশি দামে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত মানা হচ্ছে না।

গাজপ্রম সর্বশেষ শাহবাজপুর উত্তর ও ভোলা পূর্বে দুটি কূপ খনন করে। এতে ব্যয় ছিল ১৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এর চেয়েও কম মূল্যে গাজপ্রমকে কূপ খননের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবে সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় প্রতিটি কূপ খননে গাজপ্রমকে ২১ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে জ্বালানিসচিবের নেতৃত্বাধীন প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটি (পিপিসি)। এই সিদ্ধান্ত এখন ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে যাবে। এরপর চূড়ান্ত অনুমোদন দেবেন প্রধানমন্ত্রী। জ্বালানি বিভাগ ও বাপেক্স সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজপ্রমকে ২০১২ সালে দেশের যে ১০টি গ্যাসকূপ খননের ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছিল, সে অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। গাজপ্রম এ পর্যন্ত মোট ১৭টি কূপ খনন করেছে। সব কাজই পেয়েছে বিনা দরপত্রে বিশেষ জরুরি ও জ্বালানি আইনের অধীনে।

বাপেক্স কূপ খনন করতে পারত না, তা বলব না। আবার পারত, তা-ও বলছি না। কূপ খননের বিষয়ে গাজপ্রমের সঙ্গে আগেই একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ফলে গোটা বিষয়টাই বুঝতে হবে
মো. আনিছুর রহমান, জ্বালানিসচিব

ভোলা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৫ সালে। বাপেক্স ২০০৯ সাল থেকে সেখানে গ্যাস উত্তোলন করছে, যা শুধু ভোলায় ব্যবহৃত হয়।

বাপেক্স থাকতে কেন বিদেশি কোম্পানিকে কূপ খননের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে? তাহলে কি বাপেক্স কূপ খনন করতে পারত না, এমন প্রশ্নের জবাবে জ্বালানিসচিব মো. আনিছুর রহমান গতকাল বুধবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাপেক্স কূপ খনন করতে পারত না, তা বলব না। আবার পারত, তা-ও বলছি না। কূপ খননের বিষয়ে গাজপ্রমের সঙ্গে আগেই একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ফলে গোটা বিষয়টাই বুঝতে হবে।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাপেক্স আবিষ্কৃত খনিটির কূপ খননের দায়িত্ব গাজপ্রম বা অন্য কোনো বিদেশি সংস্থাকে দেওয়াটা বঙ্গবন্ধুর জ্বালানি নীতির বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান। এটি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল বলে মনে করি।’ তিনি বলেন, পঁচাত্তরের ৯ আগস্ট ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থায় বঙ্গবন্ধু বহুজাতিক কোম্পানি শেল ওয়েলের কাছ থেকে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র তিতাস, বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, রশিদপুর ও কৈলাসটিলা কিনে নেন। চার দশকের বেশি সময় ধরে ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের পরও বর্তমানে দেশের মোট উৎপাদনের ৩১ দশমিক ৪৪ শতাংশ জ্বালানি এসব গ্যাসক্ষেত্র থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জ্বালানি নীতি ছিল স্বনির্ভর বাংলাদেশ আর এখন দেশি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে এসব সম্পদ।

প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের শর্তভঙ্গ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই সঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রীও। এই মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির কোনো সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জ্বালানিমন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার বিধান রয়েছে। গাজপ্রমকে তিনটি কূপ খননের বিষয়ে ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করা হয়। এক সপ্তাহ পর এতে সই করেন প্রধানমন্ত্রী।

এই সারসংক্ষেপে হ্রাসকৃত মূল্যে কূপ খননের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও এখন সেটা মানা হচ্ছে না। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী হ্রাসকৃত মূল্যে খনন করতে বলার পরও গাজপ্রমকে আগের দাম ১৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ২১ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলারে কূপ খননের অর্থ হলো, সরকারি কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মানছেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানিসচিব মো. আনিছুর রহমান গতকাল বুধবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতাটাও বুঝতে হবে। গাজপ্রম ২০১৭ সালে ১৬ মিলিয়ন ডলারে কূপ খনন করেছে। এখন ২০২০ সাল। প্রায় চার বছর পর এসে এই দাম বেশি নয়। তা ছাড়া যেখানে গাজপ্রম কূপ খনন করবে, সেখানে উচ্চ চাপ আছে গ্যাসের।’

তবে অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর লিখিত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আর বিদেশি কোম্পানি সেখানে কাজ করতে পারে, যেখানে বাপেক্সের অভিজ্ঞতা নেই। যেমন চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা ও সাগরভাগে। সে ক্ষেত্রেও বাপেক্স তাদের সহযোগী হিসেবে থাকলে অভিজ্ঞতা তৈরি হবে।

বাপেক্স থাকতে গাজপ্রম কেন

প্রথম আলোর কাছে জ্বালানিসচিব আনিছুর রহমান দাবি করেছেন, বাপেক্সের তুলনায় বেশি দামে কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়নি গাজপ্রমকে। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ২০টি কূপ খনন করতে বাপেক্সের গড়ে খরচ হয়েছে ১৭ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলার (প্রায় দেড় শ কোটি টাকা)।

তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। আসলে ২০টি গ্যাসকূপের মধ্যে ঠিকাদার হিসেবে বিনা দরপত্রে ১৭টি কূপ খনন করেছে গাজপ্রম। ১৭টি কূপের মধ্যে ৫টি বালু-পানি উঠে বন্ধ হয়ে যায়। এগুলো হচ্ছে তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের ২০ ও ২১ নম্বর কূপ, সেমুংতাং ৬, বেগমগঞ্জ ৩ ও শাহবাজপুর ৪। পরে এই পাঁচটি কূপ খনন করে বাপেক্স। ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর পেট্রোবাংলাকে দেওয়া বাপেক্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের প্রতিবেদনে এই তথ্য রয়েছে।

বাপেক্সের একাধিক ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেছেন, গাজপ্রম প্রথম পর্যায়ে যে ১০টি কূপ খনন করেছিল, সেগুলোর ৫টিই কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায়। ওই কূপগুলো আবার সংস্কার করে গ্যাস উত্তোলন করে বাপেক্স। গাজপ্রমের ভুলে নষ্ট হওয়া কূপ খননে কিছু ব্যয় বেশি হয়েছে তখন। বাপেক্সের কোনো কূপ খনন ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার বেশি হওয়ার নজির নেই। সম্প্রতি করোনাকালের মধ্যে শ্রীকাইল পূর্ব খনন শেষ হয়েছে, এটি করতে বাপেক্সের ৮০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

রিগ আনা-নেওয়ায় অবাস্তব দর

প্রতিটি কূপ খননে গাজপ্রম গড়ে ২১ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার পাচ্ছে। গাজপ্রমের দর প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সংস্থাটি কূপ খননের যন্ত্র রিগ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিতে ১ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় দেখিয়েছে। উজবেকিস্তানের কোম্পানি এরিয়ালের কাছ থেকে রিগ নেবে গাজপ্রম। বর্তমানে এরিয়ালের রিগটি শাহবাজপুর উত্তর-১ রয়েছে। এখানে তারা সর্বশেষ কূপটি খনন করে। এখান থেকে ভোলা উত্তরে নেওয়া হবে রিগ। এই পথের দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। সেখানে কূপ খনন শেষে রিগ নেওয়া হবে শাহবাজপুর ইলশাতে। এই পথের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। আর সেখান থেকে ভোলা টগবিতে নেওয়া হবে, যার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। গাজপ্রম প্রতিবার রিগ সরাতে নেবে ১ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার করে। আবার রিগ ফিরিয়ে নিতে নেবে ৩ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার।

জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি শুধু অস্বাভাবিকই নয়, বাস্তবের সঙ্গে এটির কোনো সংগতি নেই।