ছবি না ওঠা মানুষগুলো

রিকশাটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর এভাবেই কাঁদছিলেন ফজলুর রহমানছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ফজলুর রহমানের ঋণ করে কেনা অটোরিকশাটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফজলুর রহমান শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদছিলেন।একজন আলোকচিত্র সাংবাদিক সেই মুহূর্তটি ধারণ করলেন। বুক ভেঙে যাওয়ার মতো ছবি।রিকশাওয়ালা, সিএনজিওয়ালা, কন্ডাক্টর, দোকানদার—এই শ্রেণির মানুষের জন্য মধ্যবিত্তের মন দ্রবীভূত হয়, এমন নজির কম।তবে ওই ছবিটি আমাদের বেদনার কারণ হয়েছিল।আমরা মনে চাপ নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলাম।পরদিন অবশ্য দেখলাম একজন হৃদয়বান মানুষ একটি রিকশা কিনে দিচ্ছেন ফজলুরকে।একটা দাগওয়ালা ময়লা টি–শার্ট পরে ফজলুর হাসছেন।মধুর সেই হাসি।আমরা ভারমুক্ত হলাম।নিশ্চিন্ত হলাম। ভেঙেচুরে যাওয়া রিকশার ছবিটি আমাদের মাথা থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল।

ওই সপ্তাহে শ খানেক রিকশা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।ফজলুর রহমানের মতোই একজন বজলুর রহমানও ছিলেন হয়তো। তিনিও ফজলুর মতোই করোনার সময় দোকানের কাজ হারিয়েছিলেন।তিনিও ৮০ হাজার টাকা ঋণ করেই তাঁর রিকশাটি কিনেছিলেন। তিনিও সম্ভবত কেঁদেছিলেন।তবে তাঁর ছবি ওঠেনি।তাঁর কান্না বা কাঁধের ঋণ আমরা দেখিনি।

মাহা মির্জা

ছবি না ওঠা মানুষগুলোর কথা আমরা নিশ্চয়ই দু-একবার ভেবেছিলাম, কিন্তু সাধ্যের বাইরে বলে ভাবনা এগোয়নি।চোখের সামনে বাকিদের ক্রন্দনরত ভাইরাল ছবি নেই, তাই খুব জোর দিয়ে বলতেও পারিনি ‘হয় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করো, নইলে বাকি রিকশাগুলো ফেরত দাও, সিটি করপোরেশন।’

রাষ্ট্রের দায়িত্ব কর্মসংস্থান তৈরি করা।আমাদের সংবিধানে লেখা আছে এমনটাই।করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর লাখো মানুষ যখন কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছেন, পৃথিবীজুড়ে কর্মসংস্থান বাঁচিয়ে রাখতে হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকারগুলো।এমন মারাত্মক কঠিন সময়ে মানুষের শ্রমে–ঘামে গড়ে ওঠা সচল কর্মসংস্থান নষ্ট করে কেউ? কেউ প্রশ্ন করল না, শহরে অটোরিকশা অবৈধ, তাহলে এগুলো বিক্রি হয় কেমন করে? বেচাবিক্রির সময় কোন রিকশা কোথায় চলবে, এগুলো দেখা হয় না কেন? সিটি করপোরেশন এভাবে মানুষের জীবিকার বাহন কেড়ে নিতে পারে কি না? সরকারি দলের ছেলেরা ‘অবৈধ’ বাহনের বেচাকেনা থেকে কমিশন বাগিয়ে নেন, অথচ ফজলুর রহমান রিকশা কিনলে অন্যায়? এই প্রশ্নগুলো কে করবে? কেনই-বা করবে?

‘গুদাম ভরা চাল থাকতে মানুষ না খেয়ে আছে কেন?’ পৃথিবীর সর্বোচ্চ খরচের রাস্তার দেশে এই চিৎকারটুকু করতে পারা, এই সহজ প্রশ্নের জবাব চাওয়া সামাজিক মানুষের রাজনৈতিক কাজ নয়?

দুই

করোনার সময় দেশের উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত মিলে প্রচার করেছে, ‘স্টে হোম’, অর্থাৎ ‘ঘরে থাকুন’। হাজারো মানুষ তাঁদের প্রোফাইলের ছবি বদলেছেন।‘ঘরে থাকুন’ লোগো লাগিয়েছেন।‘স্টে হোম’ খুব সম্ভবত মধ্যবিত্তের এযাবৎকালের সবচেয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা ‘প্রচারণা’ ছিল। কিন্তু কেন যে তারা টের পেল না, ঘরে বসে থাকলে এই শহরের অগণিত মানুষকে স্রেফ না খেয়ে মরতে হবে।

মধ্যবিত্ত মধ্যবিত্তের কথাই বলবে, সেটাই স্বাভাবিক।কিন্তু আলাদা কোনো দ্বীপপুঞ্জে তো বাস করি না আমরা। এ যে একেবারে গায়ে গায়ে লেগে থাকা মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরে আমাদের বেডরুম থেকে পাশের দালানের নির্মাণশ্রমিকের লেপ-তোশকের দূরত্ব বড়জোর ৫০ গজ নয়? ফ্ল্যাটের সিঁড়ির বুয়া, রডমিস্ত্রি, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি, রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, হোটেল বয় অথবা ফুটপাতে লাউ, লেবু আর বেনসন বিক্রি করা লোকটা গজ-ফিতার হিসাবে ঠিক কতখানি দূরে আপনার?

দেশি পণ্যের আসল ভোক্তা কারা? কোক, বিস্কুট, ফ্যান্টা, আলুর চিপস, কাপড় কাচার সাবান, বিউটি সোপ, জুতা, স্যান্ডেল, পানির ট্যাংক, প্লাস্টিকের চেয়ার, অ্যালুমিনিয়ামের থালাবাসন—এগুলো শুধু মধ্যবিত্তই কেনে? আর মোবাইলের মিনিট? ১০ কোটি সিম শুধুই মধ্যবিত্তের?

আপনি জানতেন না আপনার সহনাগরিকেরা দিনের চালটা দিনে খরিদ করেন? জানতেন না বড় জিডিপি আর বড় গরিবি এখানে সহাবস্থান করে? জানতেন না মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি একটা প্রহসন? ‘ঘরে থাকুন’ বলার সময় ভাবেননি একবারও এতগুলো মানুষের পক্ষে ‘ঘরে থাকুন’ মানে ক্ষুধা, ‘স্টার্ভেশন’, দুর্ভিক্ষ? জানতেন না এটা সঞ্চয়হীন মানুষের দেশ? শেষ পর্যন্ত ঘর থেকে তো বেরোতেই হতো মানুষকে—হয় কাজের সন্ধানে, নয় ভিক্ষার থালা হাতে, নইলে চুরি করতে। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঘরে মাত্র দু-চার কেজি চালের মজুতও অসম্ভব স্বপ্নের মতো এক ঘটনা! সত্যি জানতেন না? সেই হিসেবে ‘ঘরে থাকুন’ এ দেশের সচ্ছল মানুষদের এযাবৎকালের সবচেয়ে জনবিচ্ছিন্ন আহ্বান নয়?

টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনেও ছিল একই ভাষা, ‘ঘরে থাকুন’, ‘নিরাপদে থাকুন’, ‘দেশটাকে ভালো রাখুন’। অবশ্য বিজ্ঞাপন মধ্যবিত্তের জন্যই।

ধরুন, বিজ্ঞাপনের ডাকে অথবা ‘মজুতসক্ষম মধ্যবিত্তে’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের পাঁচ কোটি শ্রমিক ঘরে বসে আছেন না খেয়ে, দেশ ভালো থাকত?

এই দেশটা আসলে কার? কাদের মাথা গুনে আদমশুমারি হয় এ দেশে? কাদের করের টাকায় অবিশ্বাস্য যোগফলে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বাজেট তৈরি হয়? কাদের ‘মিনিটে’র অসামান্য যোগফলে হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে মোবাইল কোম্পানি? দেশি পণ্যের আসল ভোক্তা কারা? কোক, বিস্কুট, ফ্যান্টা, আলুর চিপস, কাপড় কাচার সাবান, বিউটি সোপ, জুতা, স্যান্ডেল, পানির ট্যাংক, প্লাস্টিকের চেয়ার, অ্যালুমিনিয়ামের থালাবাসন—এগুলো শুধু মধ্যবিত্তই কেনে? আর মোবাইলের মিনিট? ১০ কোটি সিম শুধুই মধ্যবিত্তের? যাদের কাছে পণ্য বেঁচে টিকে থাকে বহুতল করপোরেট প্রতিষ্ঠান, যাদের কাছে ‘মিনিট’ বেচে কর্মসংস্থান তৈরি হয় গ্র্যাজুয়েট তরুণের, সেই মানুষের পেট, ক্ষুধা, যন্ত্রণা এবং সেই মানুষকে লাঠিপেটা—এসব ছাপিয়ে কতগুলো মাস ধরে টিভিতে বেজে গেল আপনাদের ‘ঘরে থাকুন’ বিজ্ঞাপন! কেউ প্রশ্ন করল না, ঘরে থাকলে খাবে কী রে ভাই?

এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য ঘরে থাকার ডাক ছিল না খেয়ে মরার আহবান।কোভিড থেকে বাঁচতে খাদ্যহীনতার দিকে ঠেলে দেওয়া একমাত্র সমাধান ছিল না। খাদ্যগুদামে পড়ে ছিল ১৭ লাখ মেট্রিক টন চাল ও ডাল। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই তথ্য জ্বলজ্বল করছিল। উত্তরবঙ্গের অবারিত মাঠজুড়ে সবজি পড়ে ছিল। নষ্ট হচ্ছিল খামারিদের দুধ আর ডিম। দুই টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল কৃষকের লাউ, বেগুন, শসা। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে ওঠা শক্তিশালী, সক্ষম ও প্রশিক্ষিত অনেকগুলো বাহিনী তৈরি ছিল। ৫০ লাখ পরিবহনশ্রমিক কাজের অভাবে না খেয়ে ছিলেন। এগুলো সমন্বয়ের দায়িত্ব কার?

মধ্যবিত্তরা ঘটা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিল হাত ধোয়া ও ঘরে থাকার অমোঘ বাণী, অথচ একবারও রাষ্ট্রকে বলার সাহস তার হলো না, ‘খাদ্যগুদামে চাল পড়ে আছে, ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দাও। চাল চুরি বন্ধ করো। খাদ্য পেলেই ঘরে থাকবে মানুষ।’ ‘দূরে দূরে কাছে থাকা’র গান হলো, কিন্তু ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার গান হলো না।

তরুণেরা নেমে এসেছিলেন রাস্তায়।রান্না করে খিচুড়ি বিলিয়েছিলেন বহু মানুষ। রাষ্ট্র যা করেনি, তারুণ্য তা করেছে। কিন্তু কয়েক কোটি মানুষের শহরে ঠিক কতজনকে খাওয়াবে, কত দিন খাওয়াবে? এ যে এক অসম্ভব কাজ। তবে রাষ্ট্র আছে কেন? খাদ্য মন্ত্রণালয় কী করে? দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কাজটা কী? নাগরিক ট্যাক্স দেয় কেন? ট্যাক্স দিয়ে কাদের পালে?

মানুষ কেবল সামাজিক জীব নয়, রাজনৈতিক জীবও।সে কর দেয় বেতনের টাকা থেকে। জুতা, বার্গার, মোবাইলের সিম, গুঁড়া দুধ, চেয়ার-টেবিল বা চশমা কিনতেও সে ভ্যাট দেয়।গাড়ি, ল্যাপটপ, এসি কিনতেও ভ্যাট দেয়। জমির রেজিস্ট্রেশন করতেও সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা করে।

মানুষ ভোট দিয়ে সরকার বানায়।আর ট্যাক্স দিয়ে রাষ্ট্র পালে। কর দিয়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া মানুষের তাই রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে আলাদা হওয়ার উপায় নেই।ট্যাক্স দেব না বলার উপায় নেই।সে জন্যই জবাব চাওয়া তার কাজ।ট্যাক্সের টাকা যায় কোথায়? এই প্রশ্ন করা তার দায়িত্ব। অথচ এই প্রশ্নগুলো তার ঝামেলার মনে হয় কেন? এই প্রশ্নে তার এত ভয় কেন?

মধ্যবিত্ত রাঁধবে, খাওয়াবে, প্রোফাইলের ছবি বদলাবে, কিন্তু চিৎকার করে এই প্রশ্ন করবে না, ‘গুদাম ভরা চাল থাকতে মানুষ না খেয়ে আছে কেন?’ পৃথিবীর সর্বোচ্চ খরচের রাস্তার দেশে এই চিৎকারটুকু করতে পারা, এই সহজ প্রশ্নের জবাব চাওয়া সামাজিক মানুষের রাজনৈতিক কাজ নয়? নাকি ভালো নাগরিক মানে প্রশ্নগুলো টপ করে গিলে ফেলা? রাজনীতির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন মানবিকতা ও সামাজিকতা সুভদ্র নাগরিক তৈরি করে বটে, কিন্তু দুঃশাসনে অতিষ্ঠ সমাজের খোলনলচে পাল্টায় না। কেবল মধ্যবিত্তের রাতের ঘুমটা ভালো হয়।


মাহা মির্জা উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক