ছবি বিক্রি মানে স্বপ্ন কেনা

ব্রেইন টিউমার আর ক্যানসারকে পরাজিত করে ছোট আর্য অথল তৈতিক্ষ্য দেশে ফিরেছে। তবে তাকে পুরোপুরি সুস্থ হতে পাড়ি দিতে হবে আরও অনেকটা পথ। শুভাকাঙ্ক্ষীরা আর্যর পাশে থাকবেন, এ বিশ্বাস আর্যর বাবা বিপ্লব ভট্টাচার্য এবং মা মিনার্ভা সেঁজুতির। সেই বিশ্বাসে ভর করেই আর্যর বাবা একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করার সাহস পেয়েছেন। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া জলরঙে আঁকা ৬০টি ছবির মধ্যে যেগুলো বিক্রি হবে, তা দিয়েই তিনি এবং আর্যর মা একটি করে স্বপ্ন কিনবেন বলে জানালেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আর্যর মা মিনার্ভা সেঁজুতি লিখেছেন, ‘সেই রঙে মিশে আছে একজন বাবার চোখের জল, মায়ের কান্না, ক্যানসার আক্রান্ত ছোট শিশুর বুকের পাঁজরভাঙা কষ্ট। বিপ্লবের পেইন্টিং বিক্রয় করে আমাদের স্বপ্ন কিনব। আমাদের স্বপ্ন, আমাদের আর্য একদিন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে।’

মিনার্ভা বললেন, ‘আমরা মৃত্যু উপত্যকা ঘুরে এসেছি, আমাদের আর ভয় কি! জীবন সত্যিই একটা উপহার। এখন আর্যর বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণে শুধু আর একটু সহযোগিতা দরকার।’

কাল সোমবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চিত্রশালায় ‘জলের আখরে’ শীর্ষক এই একক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং শিল্পী অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত এ প্রদর্শনী চলবে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

বর্তমানে আর্যর বয়স সাত বছরের কিছু বেশি। মাত্র চার বছরের মাথায় ধরা পড়ে ব্রেইন টিউমার। ২০১৫ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত আর্য চিকিৎসাধীন ছিল ভারতের ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দেড় বছর কেমোথেরাপির পর এমআরআই রিপোর্ট অনুযায়ী, আর্যর টিউমারটি এখন আর নেই। তবে কেমোথেরাপির জন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত সমস্যা হচ্ছে। এখন ভয়, আবার যদি টিউমারটি তার অস্তিত্ব জানান দেয়। তাই তাকে আবার ফলোআপে যেতে হবে ভেলোরের হাসপাতালটিতে। ভয় সত্য হলে আর্যকে দিতে হতে পারে রেডিওথেরাপি। এর পাশাপাশি চলবে অন্যান্য চিকিৎসা। হাতে অর্থ না থাকলে এত দূর এসেও হয়তো থেমে যেতে হবে। কিন্তু থামতে চান না আর্যর মা ও বাবা।

বাবা-মায়ের সঙ্গে আর্য। ছবি: মানসুরা হোসাইন
বাবা-মায়ের সঙ্গে আর্য। ছবি: মানসুরা হোসাইন

বিপ্লব ভট্টাচার্য জানালেন, প্রদর্শনীতে যেসব ছবি থাকবে, তার বেশির ভাগ ছবি তিনি এঁকেছেন ভেলোরে থাকার সময়। বলেন, পরের দিনের সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে রাতে ছেলে ঘুমালে ছবিগুলো আঁকতাম। এটি বাস্তবতা থেকে পালানোর একটি কৌশল ছিল। বেশির ভাগ ছবির বিষয়বস্তু মুখ ও মুখোশ। জলরঙে একটা লেয়ারের ওপর আরেকটা লেয়ার দিয়ে ছবি আঁকতে হয়। ছেলের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই করতে গিয়ে দেখেছি মানুষের পরিবর্তন। যাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাব, ভেবেছি হয়তো তাঁদের কাছ থেকে পাইনি, আবার যাঁরা আত্মীয় নন, তাঁরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মানুষের মুখগুলো মুছে যাচ্ছে, স্থায়ী হচ্ছে না। তাই প্রদর্শনীর নাম দিয়েছি ‘জলের আখরে’।

বিপ্লব ও মিনার্ভা ছেলেকে নিয়ে দেশে ফিরেছেন গত ডিসেম্বরে। বাংলাদেশে তাঁদের এখন বাড়ি বা সংসার বলতে কিছু নেই। ফেসবুকে পরিচয় সূত্রে আত্মীয়তা হয়েছে এস আর আখতার আর নাসরিন চৌধুরী দম্পতির সঙ্গে। রাজধানীর ধানমন্ডিতে এ দম্পতির বাড়িতেই থাকছে আর্য ও তার বাবা-মা। এখান থেকেই প্রস্তুতি চলছে প্রদর্শনীর।

আজ রোববার সকালে ধানমন্ডির বাসাতেই কথা হলো যুদ্ধ জয় করা পরিবারটির সঙ্গে। আর্যর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। টেলিভিশনে কার্টুন দেখছে। চোখে সমস্যা হওয়ায় একটু পরপর টিভি স্ক্রিনের একদম কাছে চলে যাচ্ছে। ঘেমে যাওয়া, অস্থির হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যাও আছে তার। তবে আর্যর মা হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমরা যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছি, এখন আর কোনো সমস্যাকেই সমস্যা মনে হয় না। আমি রাতে ঘুমাচ্ছি, সবার সঙ্গে গল্প করছি, আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছি, এটাই আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য লাগে। আমরা আমাদের এ জীবন গত কয়েকটি বছর কল্পনাও করতে পারিনি।’

মিনার্ভা ছেলেকে নিয়ে সংগ্রামের কথা বলছিলেন। জানালেন, যখন মনে হয়েছিল আর্যকে ছাড়াই দেশে ফিরতে হতে পারে, তখন তিনি এবং তাঁর স্বামী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এমন অবস্থা হলে তাঁরা দুজন কোনো পাহাড় থেকে নিচে লাফিয়ে পড়বেন। তবে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় চিকিৎসকদের আন্তরিকতায় তা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে পাওয়া যায় এক লাখ টাকা। চিকিৎসার তহবিল গঠন এবং মানসিক সাহস জুগিয়েছেন ফেসবুক ও ফেসবুকের বাইরের শুভাকাঙ্ক্ষীরা। এই শুভাকাঙ্ক্ষীদের তালিকা অনেক বড়। কেননা যে যখন আর্যর কথা শুনেছেন, তিনিই কোনো না কোনোভাবে আর্যর পাশে দাঁড়িয়েছেন। ভেলোরে গিয়ে সাহস জুগিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরীন।

মিনার্ভা বলেন, ‘আমার ছেলেরই কেন এমন হবে তা মানতে সময় লেগেছে। ছেলের শরীর এক পাশ অবশ ছিল দীর্ঘদিন। চিকিৎসকদের মুখ থেকে শুনছিলাম, ছেলে আর চোখে না-ও দেখতে পারে। স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সারাক্ষণ প্রস্রাব ঝরতে থাকবে। শরীরের বৃদ্ধি হবে না। একসময় শুনতে হলো ছেলের শুধু টিউমার না, তাতে ক্যানসারও হয়েছে। অস্ত্রোপচারের পর দেখলাম ছেলের মাথার জায়গাটুকু স্টেপলারের পিন দিয়ে আটকানো। কেমোথেরাপি দেওয়ার সময় ছেলে চিৎকার করে বলত, শুধু আমাকেই কেন দেওয়া হচ্ছে। তবে এখন আমাদের আর্য ভালো আছে।’

ভেলোরের হাসপাতালটির নার্সরা বেশির ভাগ সময় তামিল ভাষায় কথা বলতেন। তাঁরা আর্যকে আদর করে ডাকতেন ‘চেলাকুট্টি’। এই চেলাকুট্টির জন্য নার্সরাও কেঁদেছেন বলে জানালেন মিনার্ভা। আবার আর্য যখন সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছে, তখন ওই নার্সদের মুখেই ছিল হাসি।
খেলার এক ফাঁকে আর্য জানাল, সে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়।