ছাত্র বিক্ষোভের মুখে ভ্যাট প্রত্যাহার

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সফল হলো। সরকার সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ায় শিক্ষার্থীরাও তাঁদের বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি তুলে নিয়েছেন।
ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে গত বুধবার থেকে (শুক্রবার বন্ধ ছিল) গতকাল পর্যন্ত পাঁচ দিন ধরে বিক্ষোভ করেছেন। এর পাশাপাশি বিক্ষিপ্তভাবে কর্মসূচি পালন করেন চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও সিলেটের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
গত কয়েক দিনে, বিশেষ করে বৃহস্পতিবার ও রোববার ঢাকা প্রায় অচল হয়ে পড়ে। বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচির কারণে প্রচণ্ড যানজটে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা ও এনবিআরের আদেশ: কাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর আরোপিত সাড়ে ৭ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
সন্ধ্যায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ-সংক্রান্ত বিশেষ আদেশ জারি করে। এনবিআরের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানের সই করা আদেশে বলা হয়, যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য সাধারণভাবে অতিরিক্ত ব্যয় হয় এবং যেহেতু এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ভ্যাট আরোপ করলে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার ব্যয় অধিকতর বাড়বে, সেহেতু এসব প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত সেবাকে ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাজেট গত জুন মাসে পাস হলেও প্রায় তিন মাস পর মূসক নিয়ে কতিপয় ছাত্রছাত্রী আন্দোলনে নেমেছেন। যাঁরা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক খরচ করে শিক্ষা গ্রহণ করছেন, তাঁরা অতিরিক্ত সাড়ে ৭ শতাংশ মূসক দিতে চান না। এ জন্য তাঁরা ক্লাস ছেড়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করে জনজীবন বিঘ্নিত করছেন এবং উন্নয়নের যাত্রার পথে বাধার সুযোগ করে দিচ্ছেন। সরকার কোনোভাবেই শিক্ষাঙ্গনে প্রতিবন্ধকতা এবং জনজীবনে অসুবিধা সৃষ্টি করতে চায় না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই মূসক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, মূসক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পর সরকার আশা করে যে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের আন্দোলন বন্ধ করে শিক্ষাঙ্গনে ফিরে যাবেন এবং দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টির সুযোগ দেবেন না।
ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ব্যয়বহুল স্বীকার করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনেকেই অতি নির্দিষ্ট সামর্থ্যের মধ্যে ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হচ্ছে শিক্ষা খাত। প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাস যে, জাতিকে শিক্ষা দিলেই দেশের উন্নয়নের পথে অগ্রযাত্রা দ্রুতগতি লাভ করে।
শিক্ষার উন্নয়নের জন্য সরকার প্রায় ৩৩ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিনা মূল্যে দিয়েছে উল্লেখ করে এতে আরও বলা হয়, বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে সরকার বৃত্তি ও খাদ্যসহায়তা দেয় এবং শিক্ষক সৃষ্টিতে ব্যাপক অবদান রাখে।
তবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিপরীতে মূসক প্রত্যাহার করা হয়নি। গত অর্থবছরে এই স্কুলগুলোর জন্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মূসক ছিল, চলতি অর্থবছরেও তা বহাল থাকবে।
মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে গতকাল বিকেলে অর্থমন্ত্রী নিজ কার্যালয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান ও সদস্য (মূসক নীতি) জাহাঙ্গীর হোসেনকে নিয়ে আলাদা বৈঠক করেন। এ বৈঠকের পরই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিপরীতে বর্তমানে সংকুচিত মূল্যভিত্তিতে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মূসক প্রযোজ্য থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর বর্তমানে মূসক আরোপিত নেই। আমি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পাশাপাশি এই খাতগুলোকেও মূসকের আওতায় আনার প্রস্তাব করছি।’
গতকাল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার হলেও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে আগের মতোই বহাল থাকল।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্রসংগঠন সমর্থন দেয়। সরকারি দলের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও ছাত্রলীগও গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানায়।
অন্যদিকে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবরোধের জন্য জড়ো হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টার পর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হলে শিক্ষার্থীরা আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে রাজপথ ছেড়ে দেন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গতকালও রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। সংঘর্ষ, লাঠিপেটা ও ভাঙচুরের মতো ঘটনা না ঘটলেও জনদুর্ভোগ ছিল শহরজুড়ে। বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা ছাড়া তাঁদের এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ।
তিতুমীর কলেজের সামনে অপ্রীতিকর ঘটনা: আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। দুপুর ১২টার দিকে বনানী-সংলগ্ন কাকলী মোড়ে এ ঘটনায় ২৯ জন আহত হয়েছেন বলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, তিতুমীর কলেজের দুটি বাস আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অবরোধ উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী শামীম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে তাঁদের বাস যেতে দিচ্ছিলাম। কিন্তু বাস এমনভাবে চালানো হচ্ছিল, যেন আমাদের পিষে চলে যাবে।’
কষ্ট ভুলে আনন্দ: ভ্যাট প্রত্যাহারের খবরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আনন্দের সুর বেজে ওঠে। শহরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল আনন্দ মিছিলে পরিণত হয়। উত্তরার হাউস বিল্ডিং মোড়ে সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছিলেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁরা আনন্দ ও বিজয় মিছিল শুরু করেন। তাঁরা মিছিল করতে করতে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ফিরে যান।
পান্থপথ মোড় থেকে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ তুলে নেন। তাঁদের অনেকে ক্যাম্পাসে ফিরে যান। দুপুরের পর ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে মিরপুর রোড, প্রগতি সরণির নতুন বাজার, গুলশান, চট্টগ্রামের ওয়াসার মোড়ের সিডিএ অ্যাভিনিউয়ের দুই পাশ থেকে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেন।
‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’-এর অন্যতম মুখপাত্র ফারুক আহমাদ বলেন, শিক্ষা খাতকে এগিয়ে নিতে এই ইতিবাচক সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তবে এই সিদ্ধান্ত আরও আগে নেওয়া হলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যাহত হতো না। এই আন্দোলন চলাকালে জনদুর্ভোগ হওয়ায় নগরবাসীর কাছে আন্দোলনকারীদের পক্ষে ক্ষমা চান তিনি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন ও মহাসচিব বেনজীর আহমেদ এক বিবৃতিতে ভ্যাট প্রত্যাহার করায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তাঁরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান।