ছাপা পত্রিকা যেখানে সবাইকে ছাড়িয়ে

৪ নভেম্বর ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত প্রথম আলোর প্রথম সংখ্যা

অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান মারা গেছেন ২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। এর আগে অন্তত ছয়বার তাঁকে মেরে ফেলেছিল সোশ্যাল মিডিয়া, যাকে আমরা বলি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফেসবুক। সেখানে লেখালেখি করা খুব সহজ। সম্পাদনার কোনো দরকারই নেই। গুজব বা শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে মৃত্যুর খবর লিখে দিলেই হলো। কিছুক্ষণ পরে যদি জানাও যায় যে খবরটি সঠিক নয়, মুছে দিলেই হবে।

এমন বিলাসিতা প্রিন্ট মিডিয়া বা ছাপা পত্রিকায় চলে না। ছাপার অক্ষরে একবার পত্রিকা প্রকাশ হয়ে গেলে সেই সংবাদ মুছে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। লাখ লাখ পাঠকের কাছ থেকে সেই পত্রিকা ফিরিয়ে আনারও উপায় নেই। ছাপা পত্রিকার প্রধান কাজ হচ্ছে সঠিক সংবাদটি প্রকাশ করা। এ জন্য প্রকাশের আগেই সব দিক পরীক্ষা করে দেখতে হয়। একাধিক উৎস থেকে নিশ্চিত হতে হয় যে সংবাদটি সঠিক কি না। সাংবাদিকতার নিয়ম মেনে তৈরি করতে হয় লেখা। এ কাজের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয় প্রশিক্ষিত সংবাদকর্মী। তাই বলে একজন লিখলেই তা বসিয়ে ছাপাখানায় পাঠানো হয় না। একাধিক হাতে সম্পাদনা ছাপা পত্রিকার নিয়মিত কাজেরই অংশ। সুতরাং প্রতিদিন ছাপা পত্রিকায় যে সংবাদটি পাওয়া যায়, সেটি অন্য মাধ্যমে পরিবেশিত খবরের চেয়ে অনেক বেশি সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য।

প্রথম আলোর কথাই বলা যায়। সংবাদকক্ষে যেকোনো প্রকাশিতব্য রিপোর্টের ওপর সম্পাদক মতিউর রহমানের সবচেয়ে বেশিবার লেখা কথাটি হচ্ছে, ‘দেখো, ভাবো’। এমনকি সম্পূর্ণ প্রস্তুত বড় বা অনুসন্ধানী কোনো সংবাদ প্রস্তুত করে ছাপার জন্য নিয়ে গেলে তিনি অবধারিতভাবে বলবেনই, ‘আরেকটি দিন দেখো, আরও খোঁজ নাও’। এর কারণ, প্রথম আলোর নির্ভরযোগ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখা, যা অর্জিত হয়েছে বছরের পর বছর ধরে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মাধ্যমে। পাঠকদের বারবার মনে করিয়ে দেওয়া, ‘ছাপার অক্ষরে যে লেখা পড়ছেন, তার সত্যতা প্রমাণিত।’ যুগ যুগ ধরে সারা বিশ্বে প্রিন্ট মিডিয়া বা ছাপা পত্রিকা টিকে আছে এর বিশ্বাসযোগ্যতার ওপরেই ভর করে।

ছাপা পত্রিকার বয়স ২০০ বছরের বেশি। সারা বিশ্বেই ছাপা পত্রিকার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণিত, যাকে বলা হয় ‘প্রিন্ট ইজ প্রুফ’। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে পাশের দেশ ভারতের পত্রিকাগুলো একজোট হয়ে ‘প্রিন্ট ইজ প্রুফ’ নামে প্রচারণায় কেন নেমেছিল? ২০১৯ সালে প্রচারণাটি শুরু করেছিল মূলত ভারতের দৈনিক ভাস্কর গ্রুপ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় টাইমস অব ইন্ডিয়া গ্রুপ, হিন্দুস্তান টাইমস বা এইচটি মিডিয়া গ্রুপ এবং দ্য হিন্দু। মূলত প্রিন্ট মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতার বিভিন্ন দিক, তথ্য ও খবরের উৎস যাচাইপ্রক্রিয়া, খবরের মান নিয়ন্ত্রণ এবং সাংবাদিকতার শৃঙ্খলার দিকটি সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্য দুই মাসের এই প্রচারণা চালানো হয়েছিল।

আসলে ইন্টারনেট প্রসারের এই যুগে আমরা সবাই যে তথ্যাভিজ্ঞ বা অবহিত জাতি (ইনফর্মড সোসাইটি) চাই, সেখানে কিছুটা ধাক্কা লাগছে। মিথ্যা, ভুয়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ ছড়ানোর নানা পথ তৈরি করা হয়েছে। করোনার অতিমারির সময়ে, দেশে দেশে জন–আন্দোলনের যে কোনো ঘটনায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বা যেকোনো দেশের জাতীয় নির্বাচনকালে, এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়েও যেভাবে মিথ্যা বা ভুয়া সংবাদ ছড়ানো হচ্ছে, তাতে সঠিক তথ্য পাওয়াটাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এতে মানুষ সঠিক তথ্য জানতে পারছে না, এমনকি মানুষের জীবনও বিপন্ন হচ্ছে। তাই তো কোভিড-১৯ সংক্রমণের সময়ে অতিমারি নিয়ে ভুয়া বা বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়ানোর নামই দেওয়া হয়েছিল ‘ইনফোডেমিক’ বা তথ্যমারি।

যেমন ফেসবুকে অনায়াসে লিখে দেওয়া সম্ভব যে থানকুনি পাতা খেলে করোনার সংক্রমণ হবে না। এক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক বাঘের ছবি টুইটারে লাখ লাখ রিটুইট হলো, যেখানে লেখা— মানুষকে ঘরে রাখতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন রাস্তায় ৮০০ বাঘ ছেড়ে দিয়েছেন। আবার আততায়ীর গুলিতে নিহত বিটলসের গায়ক জন লেননের স্ত্রী ইয়োকো ওনোর একটি বক্তব্য প্রকাশ করল এক অনলাইন সংবাদমাধ্যম। শিরোনাম ছিল, ‘৭০–এর দশকে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল’। ওই নিউজটি কেবল ফেসবুকেই শেয়ার হয়েছিল ৯ লাখ ৩৪ হাজার বার। মূলধারার কোনো ছাপা পত্রিকায় কিন্তু এসব লেখা প্রকাশের সুযোগ নেই। সুতরাং বর্তমান ‘ডিজিটাল দুনিয়া’য় কে বিশ্বাসযোগ্য আর কে নয়, তা জানার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।

ইন্টারনেটের প্রসারে এখন কেবল যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিড় বাড়ছে তা নয়, অনলাইন সংবাদমাধ্যমও তৈরি হচ্ছে রাতারাতি। কিন্তু সাংবাদিকতার নিয়ম না মানায় টিকে থাকতে পারছে না অনেকেই। বিশ্বাসযোগ্যতার দিক থেকে এখানেও প্রাতিষ্ঠানিক ও মূলধারার প্রিন্ট বা পত্রিকাগুলোর রাজত্ব। এখন প্রায় সব পত্রিকারই একটি করে অনলাইন সংস্করণ আছে। এসব সংস্করণেও সংবাদ প্রকাশ করা হয় ছাপা পত্রিকার মতোই নিয়ম মেনে। মেনে চলা হয় সংবাদ প্রচার বা প্রকাশের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রথম আলো—কোনোটিই এর ব্যতিক্রম নয়। ছাপা পত্রিকায় এই ধারাবাহিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর দৃঢ় ভিত্তি গড়েই প্রথম আলো এখন বিশ্বের ১ নম্বর বাংলা সংবাদমাধ্যম।

তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয়তা বা অনলাইন সংবাদমাধ্যমের প্রসারের বিপক্ষে আমরা কেউ নই। অবশ্য অনেকেই ফেসবুককে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ বলতে নারাজ। কেননা, যেখানে তথ্য যাচাই বা সম্পাদনার কোনো ব্যবস্থা নেই, তাকে মিডিয়া বলা কতটা সংগত, তা নিয়ে তাত্ত্বিক তর্ক আছে। এখানে সাংবাদিকতার ন্যূনতম শর্তও পূরণ করা হচ্ছে না। আবার অনেকেই মনে করেন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ভুঁইফোড় অনলাইনে মিথ্যা বা ভুয়া সংবাদের ছড়াছড়ি আসলে এই সময়ে সাংবাদিকতার সুগভীর প্রয়োজনটাই নতুন করে তুলে ধরেছে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের অধ্যাপক চার্লি বেকেট এই দলে পড়েন। ‘ফেক নিউজ: দ্য বেস্ট থিং দ্যাটস হ্যাপেন্ড টু জার্নালিজম’ শিরোনামে এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘ফেক নিউজ বা ভুয়া সংবাদ হচ্ছে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কয়েক দশকের মধ্যে ঘটে যাওয়া সেরা জিনিস। এর মাধ্যমে মূলধারার গণমাধ্যমকে আরও গুণমানসম্পন্ন সাংবাদিকতা দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছে, যে সাংবাদিকতার সঙ্গে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও নৈতিকতার মিশেল রয়েছে।’

চার্লি বেকেটের কথা মেনে বলা যায়, যাঁরা সঠিক সাংবাদিকতা করছেন, টিকে আছেন কেবল তাঁরাই। হারিয়ে যাচ্ছেন অন্যরা। কোভিড-১৯ অতিমারির কঠিন সময়ে কথাটি আরও বেশি সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

প্রিন্ট মিডিয়ার জয়জয়কার কেবল ভালো সাংবাদিকতার জন্যই নয়, মার্কেটিং বা বিপণনের দিক থেকেও এর গুরুত্ব রয়েছে। বিপণনে প্রিন্ট মিডিয়ার প্রাসঙ্গিকতা গবেষণায়ও প্রমাণিত। ট্রুইমপ্যাক্ট কানাডাভিত্তিক একটি নিউরো মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান। তাদের করা গবেষণার ভিত্তিতে জনপ্রিয় মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফোর্বস-এ প্রকাশিত লেখার শিরোনাম হচ্ছে, ‘পেপার বিটস ডিজিটাল ইন ম্যানি ওয়েজ’। ডিজিটাল প্রসারের এ সময়ে অনেকেরই ধারণা, পণ্যের প্রচারে ডিজিটাল মাধ্যমই সবচেয়ে উপযুক্ত ও কার্যকর। অথচ ট্রুইমপ্যাক্টের গবেষণায় দেখা গেছে, পত্রিকাভিত্তিক বিপণনই মস্তিষ্কে বেশি প্রভাব ফেলে, ছাপা হওয়া বিজ্ঞাপনকেই সবাই বেশি স্মরণ (ব্র্যান্ড রিকল) করতে পারেন, ছাপা বিজ্ঞাপন মানুষ বেশি সময় ধরে দেখেন, মনোযোগও বেশি ধরে রাখতে পারে ছাপা বিজ্ঞাপন। ভোক্তাদের সংযুক্ত করে লক্ষ্যভিত্তিক প্রচারণা ও বিপণনেও প্রিন্ট মিডিয়া বা ছাপা পত্রিকার কার্যকারিতা গবেষণাতেই প্রমাণিত।

স্থায়িত্বের দিক থেকেও প্রিন্ট বা ছাপা পত্রিকা প্রতিযোগিতাহীন। সংরক্ষণ করা যায় যেকোনো সংবাদ। দুই তরুণ সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টেইন আর বব উডওয়ার্ড ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর ওয়াশিংটন পোস্ট–এ ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে যে সংবাদটি প্রকাশ করেছিলেন, সেটি এখনো পাওয়া যায়। সেই সংবাদটি আরও ১০০ বছর পরেও আলোচিত থাকবে। প্রভাবশালী মার্কিন পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট–এর সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রকাশক ফিলিপ এল গ্রাহাম বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকতা হচ্ছে ইতিহাসের প্রথম খসড়া’।

আজ যা ছাপা হচ্ছে, সেটাই একসময় হবে ইতিহাসেরই অংশ। প্রিন্ট মিডিয়া বা ছাপা পত্রিকার গুরুত্ব এখানেই।

শওকত হোসেন: হেড অব অনলাইন, প্রথম আলো